বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশটির ভেতরে ও আশপাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক তৎপরতা দিন দিন জটিল ও স্পর্শকাতর হয়ে উঠছে। ভারত, চীন, পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমীকরণে এখন বাংলাদেশ একটি কৌশলগত কেন্দ্রবিন্দু। বিশেষ করে গোয়েন্দা কার্যক্রম ও ক্ষমতার পালাবদলে বিদেশি হস্তক্ষেপ নিয়ে নানা উদ্বেগ ঘনীভূত হচ্ছে। ঢাকায় এখন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ (RAW), পাকিস্তানের আইএসআই, যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ এবং ইসরায়েলের মোসাদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।
এক সময় দক্ষিণ এশিয়ায় নিরঙ্কুশ প্রভাব রাখলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের আধিপত্যে টানাপোড়েন দেখা যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এখন আগের মতো সহজ নয়। উদাহরণস্বরূপ, পক প্রণালির ওপর স্থলসেতু নির্মাণের প্রস্তাবিত প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছে শ্রীলঙ্কা, যদিও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক কলম্বো সফরে সেটিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশে ভারতের অর্থায়নে চলমান রেল প্রকল্প স্থগিত করা হয়েছে ‘শ্রমিক নিরাপত্তা’ এবং ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা’র কারণ দেখিয়ে। পাশাপাশি, নেপাল চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (BRI) আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিয়ে ভারতের কৌশলগত অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করেছে।
বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের পর পাকিস্তান কৌশলগতভাবে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সক্রিয়। পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ এবং পরে উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার একের পর এক সফরে এসেছেন ঢাকায়। এই সফরগুলো ভারতকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। কারণ, এ অঞ্চলে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সক্রিয়তা বেড়েছে। তাদের টার্গেট বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও জটিল করা এবং ভারতীয় স্বার্থে আঘাত হানা।
ভারতের ‘র’ দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে কার্যকর ছিল। তবে এখন তারা কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে। আইএসআই, সিআইএ ও মোসাদের সমন্বিত তৎপরতায় ‘র’-এর একক আধিপত্য ভেঙে পড়ছে। ঢাকায় এই চারটি গোয়েন্দা সংস্থার সক্রিয় উপস্থিতি এখন ওপেন সিক্রেট। রাজনৈতিক দল, সেনা ও পুলিশ বাহিনী, ব্যবসায়ী ও আমলাতন্ত্রে তাদের প্রভাব ও নজরদারি বিস্তৃত।
তথ্য রয়েছে, এই সংস্থাগুলোর যৌথ পরিকল্পনায় আওয়ামী লীগের মাঠে ফেরার প্রস্তুতি, বিএনপির ভেতর বিভাজন, এবং জাতীয় ঐক্য সংহতি নষ্ট করার পরিকল্পনা চলছে। এনসিপি-নেতৃত্বাধীন সংস্কার প্রক্রিয়াকে অর্থ দিয়ে সীমাবদ্ধ রাখার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক এলিটদের বিলাসী জীবনধারা পর্যবেক্ষণেও তারা সক্রিয়।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে ঘনিষ্ঠ হলেও চীনকে ঠেকাতে এই জোটের কূটনৈতিক হিসাব-নিকাশ বেশ জটিল। যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের ভারত সফরে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একইসাথে চীন হংকং ইস্যুতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পাল্টা জবাব দিয়েছে, যা পুরো অঞ্চলে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো, বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে সবচেয়ে আকর্ষণীয় থিয়েটার হয়ে উঠেছে। একদিকে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পুনর্গঠন, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক কৌশলগত দ্বন্দ্বে দেশটি অগ্নিপরীক্ষার মুখে। বিশেষ করে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর আগ্রাসী তৎপরতা বাংলাদেশের নিরাপত্তা, কূটনীতি এবং স্বার্বভৌমতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
এই পরিস্থিতিতে দেশের গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর দায়িত্ব অনেক বেড়েছে। সময় এসেছে নিজেদের কৌশলগত স্বার্থ সংরক্ষণে যথাযথ নীতিনির্ধারণ ও কার্যকর নজরদারি নিশ্চিত করার।
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?