কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশ এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশর স্বাস্থ্যসেবা খাত সীমিত সম্পদ, প্রশিক্ষিত লোকবলের অভাব এবং কোভিড মহামারীর মতো অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এআই প্রযুক্তির অগ্রগতি এই চ্যালেঞ্জগুলোর কিছু কাটিয়ে উঠতে এবং স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহ ও সহজলভ্যতার উন্নতি করতে সাহায্য করতে পারে। এই নিবন্ধে, আমরা দেখার চেষ্টা করব কীভাবে উন্নত এআই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতিতে সাহায্য করতে পারে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বর্তমান চিত্র:
সাধারণ মানুষের চোখে যদি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দেখি তাহলে কী দেখতে পাই? সাধারণ মানুষ যে কোনো স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়লে প্রথমে বাড়ির পাশের ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে ব্যবহার করে (যা আসলে অনেক ক্ষেত্রে ভয়াবহ ক্ষতিকর) ফার্মেসির ওষুধে কাজ না করলে কোন পরিচিত ডাক্তার এর কাছ থেকে পরামর্শ নেয়। এতেও কাজ না করলে এক বা একাধিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের থেকে পরামর্শ নেয়, নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করে রোগের উপশম করে যা স্বাস্থ্য সেবার ভাষায় ওপিডি সেবা বা বহির্বিভাগের সেবা বলে। এই পর্যায়ে এসে প্রায় ৬০%-৭০% রোগী সুস্থ হয়ে যায়, বাকি রোগীদের হয়তো অপারেশন বা দীর্ঘ মেয়াদী সেবার দরকার হয় যার জন্য হসপিটালে ভর্তি হতে হয়।
স্বাস্থ্য সচেতনতাও তৈরি হয় অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক আলোচনা ও ভুক্তভোগীদের দেখে শেখার মাধ্যমে। যা অনেক সময়ই গুজব নির্ভর হয়ে থাকে। যদিও এখন সরকারিভাবে অনেক স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক তথ্য প্রচার করা হয়। তবে একটি বিষয়ে বাংলাদেশ বেশ ভালো অবস্থানে আছে যা অনেক ক্ষেত্রে অনেক উন্নত দেশ থেকেও ভালো। সেটা হল প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা যা সার্বজনীন টিকাদান কর্মসুচির মাধ্যমে করা হয়।
যা হোক, দেশের মোট স্বাস্থ্য খাতের খরচের প্রায় ৬০%-৭০% খরচ হয় হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে পেতে হয় এমন সেবার জন্য। যদিও এইসব খাতে এখন নানা রকম উদ্ভাবন এসেছে, টেলিমেডিসিন এবং অনলাইন মেডিক্যাল সেবা অন্যতম। এখন আমরা দেখবো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষ করে এই সব খাতে এবং হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সেবায় ব্যবহার করা যায় এবং স্বাস্থ্যসেবা সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যেতে পারে।
উন্নত রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা:
উন্নত এআই প্রযুক্তি রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার নির্ভুলতা এবং দ্রুততম করতে সাহায্য করতে পারে। মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমগুলো সম্ভাব্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি বা রোগ নির্ণয় শনাক্ত করতে মেডিকেল ইমেজ (এক্সরে, এমআরআই, ইসিজি প্রভৃতি), ক্লিনিক্যাল নোট এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত ডেটাসেটগুলো বিশ্লেষণ করতে পারে। এটি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের আরও সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করতে এবং রোগীর চিকিৎসা ইতিহাস, লক্ষণ এবং অন্যান্য কারণের উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করতে সহায়তা করতে পারে। যাতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কম সময়ে বেশি রোগীদের সেবা দিতে পারেন।
বাংলাদেশে, যেখানে স্বাস্থ্যসেবা সেবার অবকাঠামো সীমিত, সেখানে এআই এই ব্যবধান পূরণ করতে এবং আরও সঠিক এবং দ্রুত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা প্রদান করতে সাহায্য করতে পারে। উপরন্তু, এআই চিকিৎসা সংক্রান্ত মানবীয় ত্রুটি কমাতে এবং রোগ নিরুপণ পদ্ধতি উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। যাতে হয়তো সাধারণ মানুষের ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খাওয়ার মত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে।
টেলিমেডিসিন এবং দূরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা:
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুক্ত করে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে ভিডিও কনফারেন্সিং এবং দূরবর্তী পর্যবেক্ষণের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে সেই সব রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য যারা ব্যক্তিগতভাবে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যেতে অক্ষম। এটি গ্রামীণ এলাকায় বিশেষভাবে কার্যকর হতে পারে যেখানে স্বাস্থ্যসেবা সেবা অবকাঠামো সীমিত।
এআইচালিত চ্যাট বট ও রিমোট মনিটরিং সিস্টেমগুলো স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের মাতৃত্বকালীন চেক-আপ, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো দীর্ঘস্থায়ী অবস্থার রোগীদের নিরীক্ষণ করতে সহায়তা করতে পারে। এটি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের সম্ভাব্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি শনাক্ত করতে এবং অবস্থার অবনতি হওয়ার আগে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করতে পারে, যা স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় কমিয়ে আনতে পারে।
স্বাস্থ্যসেবা সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার:
উন্নত এআই প্রযুক্তি স্বাস্থ্যসেবার চাহিদার পূর্বাভাস, স্বাস্থ্যসেবার প্রবণতা পূর্বাভাস এবং স্বাস্থ্যসেবা সংস্থান বরাদ্দের ফাঁক শনাক্ত করে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা সংস্থাগুলোকে অপ্টিমাইজ করতে সাহায্য করতে পারে। মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম রোগীর রেকর্ড, চিকিৎসা দাবি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত ডেটার বড় ডেটাসেট বিশ্লেষণ করে প্যাটার্ন এবং প্রবণতা সনাক্ত করতে পারে যা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের চিকিৎসা সরবরাহ, কর্মী এবং সরঞ্জামের মতো সংস্থাগুলোকে আরও ভালভাবে বরাদ্দ করতে সাহায্য করতে পারে।
এআই ভবিষ্যতের স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়তাও ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে, যেমন নির্দিষ্ট কিছু রোগের প্রাদুর্ভাব, হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা এবং নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতির চাহিদা। স্বাস্থ্যসেবা প্রবণতা সঠিকভাবে পূর্বাভাস দিয়ে, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা ভবিষ্যতের চাহিদাগুলোর জন্য আরও ভালভাবে প্রস্তুত করতে পারে এবং আরও কার্যকরভাবে সম্পদ বরাদ্দ করতে পারে। যা কোভিড মহামারীর মত অবস্থা ভালোভাবে মোকাবেলা করতে সহায়তা করতে পারে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সচেতনতা:
উন্নত এআই প্রযুক্তি বাংলাদেশে স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত বিপুল পরিমাণ তথ্যের বিশ্লেষণ করে এবং প্রাসঙ্গিক এবং সঠিক স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত বিষয়বস্তু তৈরি করে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সচেতনতা উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমগুলো প্রাসঙ্গিক এবং নির্ভুল স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত বিষয়বস্তু সনাক্ত করতে বিভিন্ন উৎস থেকে ডেটা বিশ্লেষণ করতে পারে, যেমন চিকিৎসা গবেষণা নিবন্ধ, রোগীর ফোরাম এবং সোশ্যাল মিডিয়া।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করে বিভিন্ন স্বাস্থ্য বিষয়ক জনসাধারণকে শিক্ষিত করার জন্য নিবন্ধ, ভিডিও এবং ইনফোগ্রাফিকের মতো শিক্ষামূলক উপকরণ তৈরি করা যেতে পারে। এটি সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য সচেতন করতে সাহায্য করতে পারে। তাতে করে মানুষ সামাজিক গুজব নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
চ্যালেঞ্জ এবং সীমাবদ্ধতা:
যদিও উন্নত এআই প্রযুক্তির বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি আনার সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানে কিছু চ্যালেঞ্জ এবং সীমাবদ্ধতা রয়েছে যা মোকাবেলা করা প্রয়োজন। একটি বড় চ্যালেঞ্জ হল নির্ভরযোগ্য এবং সঠিক তথ্যের অভাব। বাংলাদেশের উচ্চ-মানের মেডিক্যাল ডেটার সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা এআই মডেলগুলোকে কার্যকরভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া চ্যালেঞ্জিং করে তুলতে পারে।
উপরন্তু, এআই প্রযুক্তি বাস্তবায়নের খরচ বাংলাদেশের জন্য ব্যয়বহুল হতে পারে। এআই মডেলগুলোর দ্বারা উৎপন্ন ফলাফলগুলোকে কার্যকরভাবে ব্যবহার এবং ব্যাখ্যা করার জন্য এআই এবং মেশিন লার্নিং সম্পর্কে জ্ঞানসহ আরও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা দানকারী পেশাদারদের জনবল প্রয়োজন। তাছাড়া বাংলাদেশের বর্তমান আইন এআই মডেলগুলো থেকে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে ওষুধ কেনার অনুমতি দেয় না। তবে সরকার যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপকারিতা বুঝতে পারে তবে হয়তো পরীক্ষামূলকভাবে অনুমতি দিতে পারে।