ভয়াবহ বন্যায় অবর্ণনীয় কষ্টে পাঁচ জেলার লাখো মানুষ

ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যায় অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছেন চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলার মানুষ। চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন রয়েছে কক্সবাজার ও বান্দরবানের।

বন্যার পানিতে তলিয়ে মারা গেছেন চারজন। এরমধ্যে রয়েছেন চট্টগ্রামের রাউজানে ব্যবসায়ী, লোহাগাড়ায় বৃদ্ধ, কক্সবাজারের চকরিয়ায় কিশোর এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে কৃষক। এছাড়া কক্সবাজারের চকরিয়ায় কিশোর ও রাঙামাটির বরকলে এক যুবক নিখোঁজ রয়েছেন।

এদিকে, পেকুয়ায় বেড়েছে সাপের উপদ্রব। সাপ আর মানুষের পাশাপাশি অবস্থান মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়েছে। ইতোমধ্যেই সাপের কামড়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। কোমর সমান পানিতে ডুবে রয়েছে অনেক এলাকার বাড়িঘর ও প্রশাসনিক ভবন। অন্য সবকিছুর মতোই সেসব এলাকার টিউবওয়েলগুলো ডুবে থাকায় বিশুদ্ধ পানির অভাব তীব্রতর হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে ঠিকই কিন্তু অনেক এলাকায় সরকারি বরাদ্দ এখনো পৌঁছেনি। আর যেসব এলাকায় ত্রাণ পৌঁছেছে, তাও পরিমাণে কম। গবাদি পশু নিয়ে গোখাদ্যের সংকটে বিপাকে পড়েছেন অনেকেই।

মুহূর্ত নিউজের ব্যুরো ও স্থানীয় প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কৃষক ও মৎস্যজীবীদের। পানি নামতে শুরু করলেও ভেসে উঠছে বন্যা পরবর্তী ক্ষত। অনেক সড়ক ভেঙে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে গেছে। বিধ্বস্ত বাড়িঘর, ফসলি জমি ও মাছের ঘেরের ক্ষতি দেখা যাচ্ছে। বুধবারও অনেক এলাকা বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন ছিল। দুর্গত মানুষের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছে সেনাবাহিনী।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জানা গেছে টানা তৃতীয় দিনের মতো বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী জেলা কক্সবাজার ও বান্দরবানের সড়ক যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন রয়েছে। আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধি জানিয়েছেন, যোগাযোগ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠতে আরো সময় লাগবে। রাতে বৃষ্টি না হওয়ায় সকালে সড়কের ওপর থেকে পানি কিছুটা কমলেও দুপুরের পর বৃষ্টিতে তা আবারও বেড়ে যায়। এ কারণে সড়ক যোগাযোগ চালু হয়নি। তবে আনোয়ারা-বাঁশখালী-পেকুয়া আঞ্চলিক মহাসড়ক দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যান চলাচল করছে।

এছাড়া চট্টগ্রাম নগরীর সঙ্গে বেশকিছু উপজেলার সড়ক যোগাযোগও বন্ধ রয়েছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের উপজেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া। এ দুই উপজেলায় দুর্গত মানুষের পাশে থেকে কাজ করছে সেনাবাহিনী। কোমরসমান পানিতে ডুবে গেছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সাতকানিয়া থানা ভবন। সংকট দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির। অন্যান্য উপজেলার মানুষও অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।

পাহাড়ি ঢল ও প্রবল বর্ষণে দক্ষিণ চট্টগ্রামে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। টাকার অঙ্কে যা শতকোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা জনপ্রতিনিধি ও জেলা প্রশাসনের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া লোহাগাড়া ও চন্দনাইশে ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে।

রাউজানে হালদা নদীর শাখা খালে বন্যার পানির প্রবল স্রোতে ডিঙি উলটে নিখোঁজ হওয়ার ৩৪ ঘণ্টা পর তরুণ শাহেদ হোসেন বাবু নামের একজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বুধবার ভোর চারটায় মৃতদেহটি উপজেলার মোকামীপাড়া হালদা নদীর ছায়াচরে স্থানীয়রা দেখতে পায়। পরে খবর পেয়ে সেখান থেকে এলাকার লোকজন শনাক্ত করে নিয়ে আসেন। তিনি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়নের চার নং ওয়ার্ডের উজির আলী মিয়াজীর বাড়ির এসএম ইউসুফ সিআইপির বড় ছেলে। এছাড়া বুধবার সকালে লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের চুনতিপাড়া খাল থেকে ভাসমান অবস্থায় কৃষক আসহাব মিয়ার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের চট্টলা পাড়ার কালু মিয়ার ছেলে। কর্ণফুলী উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নের কয়েক হাজার বাড়ির বাসিন্দা পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

এদিকে, কক্সবাজার, চকরিয়া ও পেকুয়া’য় মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে বৃষ্টির মাত্রা কমে এসেছে। এ পরিস্থিতিতে বন্যাকবলিত এলাকার পানি নামতে শুরু করেছে। তবে পানি নামতে শুরু করায় যারা ঘরে ফিরেছেন, তারা পড়েছেন নতুন দুশ্চিন্তায়। রান্না করে খাওয়ার কোনো পরিবেশ নেই। ওই এলাকার বাসিন্দা রহিম উদ্দিন বলেন, ‘চার দিন ধরে কমপক্ষে ৪-৫ ফুট পানিতে বন্দি অবস্থায় ছিলাম। এখন পানি নামতে শুরু করেছে। এর সঙ্গে সড়কের ভাঙন, বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও মাছের ঘেরের ক্ষতি দেখা যাচ্ছে। ঘরবাড়িতে রান্না করার সুযোগ নেই। বাড়ির ভেতরে পানি বের করার চেষ্টা করছি। খাবার পানিও পাওয়া যাচ্ছে না।’

বুধবার সকালে চকরিয়া উপজেলার সুরাজপুর মানিকপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড এলাকায় মাতামুহুরি নদী থেকে বৃদ্ধ আনোয়ার হোসেনের লাশ উদ্ধার করেছে স্থানীয়রা। তার বাড়ি ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ড নয়াপাড়ায়। একই দিন দুপুরে উপজেলার পূর্ব বড় ভেওলা ইউপির ৩নং ওয়ার্ড হাজী রওশন আলীপাড়াসংলগ্ন রেললাইনের কালভার্টের নিচে স্থানীয় আবদুল মালেক মানিকের ছেলে মোহাম্মদ আসিফ (১২) বন্যার পানির স্রোতে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছে। পেকুয়া সদরের আনর আলী মাতব্বরপাড়ায় সাপের কামড়ে নাছির উদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ী মারা গেছেন। অনেকে সড়ক বা উঁচু কোনো স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। বহু মানুষ ঘরের ভেতরে মাচা বেঁধে বসবাস করছেন।

বৃষ্টিপাত কমায় চার দিন পর বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বান্দরবান ও নাইক্ষ্যংছড়ি’তে। তবে সব উপজেলা এবং সারা দেশের সঙ্গে বান্দরবান জেলার সড়ক যোগাযোগ এখনো বিচ্ছিন্ন রয়েছে। চার দিন ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন জেলায় খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। জেলায় দুই শতাধিক আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছে ২০ হাজারের বেশি মানুষ। বুধবার সকালে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সোনাইছড়িতে বন্যার পানির স্রোতে নিখোঁজ ফংছা মার্মা নামে একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি সোনাইছড়ির ঠাকুরপাড়ার ৪নং ওয়ার্ডের মংক্য মার্মার ছেলে। তবে, রাঙামাটিতে ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্গত লোকজনের দুর্ভোগ এখন চরমে। পাহাড়ি ঢলে বিস্তীর্ণ নিচু এলাকা প্লাবিত হয়ে বিস্তর ফসলি জমি ও অসংখ্য বাড়িঘর তলিয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়। সেখানে দুর্গত মানুষের সহায়তায় জরুরি ত্রাণ বিতরণসহ সর্বাত্মক কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, সদরসহ জেলায় ২০৫ স্থানে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ হাজার ৮৪৭টি বাড়িঘর। বিভিন্ন সড়কে ভাঙন হয়েছে ৪৯ স্থানে। কালভার্ট ক্ষতি হয়েছে ৯টি। এসব কারণে বিভিন্ন সড়কে সাময়িকভাবে যানবাহন চলাচল বিঘ্ন ঘটছে। ফলে বাঘাইছড়ির সাজেকে আটকা পড়েন তিন শতাধিক পর্যটক। এছাড়া পাহাড়ধসে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ হাজার ২৫০ হেক্টর ফসলি জমি। বিদ্যুতের খুঁটি হেলে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে বিদ্যুৎ সংযোগ। বরকলে প্রবল স্রোতে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ রয়েছেন এক যুবক।

খাগড়াছড়িতে বন্যা পরিস্থিতির কিছু উন্নতি হলেও এখনো প্লাবিত নিচু এলাকা। সদর উপজেলার পানি কমলেও এখনো পানিবন্দি দীঘিনালা উপজেলার ৩ ইউনিয়ন। এতে বন্দি হয়ে আছে অন্তত ৯শ পরিবার।

বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণ সহায়তা দিয়েছে সেনাবাহিনীর দীঘিনালা জোন। দুপুরে কবাখালি ও মেরুংয়ের আশ্রয়কেন্দ্রে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়। এ সময় সেনাবাহিনীর দীঘিনালা জোনের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর নাফিজ জানান, ‘যতদিন বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, ততদিন সেনাবাহিনীর পক্ষে পর্যায়ক্রমে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হবে।’