বান্দরবানে বন্যায় বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ, নেই সুপেয় পানি ও বিদ্যুৎ

গত কয়েক দিনের টানা ভারী বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বান্দরবান জেলা। বান্দরবান শহরের প্রায় ৯০ ভাগ এলাকাই প্লাবিত হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে তিন দিন ধরে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় এবং সেই সাথে খাওয়ার পানির সংকটে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন পার্বত্য এই জেলার বাসিন্দারা।

বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় বান্দরবান সদর, লামা, রুমা, থানচি, আলীকদমসহ ও রোয়াংছড়ি উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। বিদ্যুতের সাথে মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় যোগাযোগব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছে।

বান্দরবান সদরের বেশিরভাগ ঘরবাড়িই পানির নিচে তলিয়ে গেছে। অনেকের ঘরের দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত পানিতে ডুবে গেছে। হঠাৎ পানি বেড়ে যাওয়ায় অধিকাংশ মানুষ ঘর থেকে কিছুই বের করতে পারেননি। বাধ্য হয়ে তাই অনেকেই সাইক্লোন সেন্টারে আশ্রয় নিয়েছেন।

বান্দরবান সদরের বাসিন্দা রামপদ দাস বলেন, ‘গতরাত থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকাও তুলতে পারছি না।’

বান্দরবান সদরে রাজগুরু বিহার এলাকায় কলাপাড়া বাসিন্দা অংসাই ম্যা মারমা জানান, এবারের মতো এত দ্রুত পানি বৃদ্ধি ও জেলা শহরের ভেতরে জলাবদ্ধতা এর আগে কখনো দেখিনি। আমাদের বাড়ির আসবাবপত্রসহ সব জিনিসপত্র পানিতে ভিজে গেছে। বাড়িতেও গলা সমান পানি উঠেছে। বাসায় থাকতে না পেরে পুরো গ্রামবাসী রাতে ভিক্ষু পরিষদে তিন তলায় গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে। রাজগুরু বৌদ্ধবিহারের (খিয়ং ওয়া ক্যং) পুরো প্রাঙ্গণ পানিতে ডুবে গেছে।

বান্দরবান সদরের তিন নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার অজিত দাস বলেন, গতকাল দুপুরে পাহাড়ধসে বান্দরবান সদরে একই পরিবারের মা-মেয়ে মারা গেছেন বলে জানতে পেরেছি।

অনেক কষ্ট করে ধার দেনা করে জেলার অনেক কৃষকই তিলের ক্ষেত, বিভিন্ন সবজির বাগান করেছিলেন। অনেক কষ্টে চাষ করা সেই ফসল পানির নিচে তলিয়ে যেতে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্থানীয় রুমা উপজেলার এক কৃষক উথোয়াই মং মারমা। তিনি বলেন, ‘ সব পানিতে চলে গেল। সব পরিশ্রম শেষ। একদিকে ফসল নেই, অন্যদিকে ঘরের হাঁস মুরগি, গবাদি পশু কোথায় আছে, বেঁচে আছে কিনা সেটাও জানি না।’

থানচির বলিপাড়া বাগান পাড়ার বাসিন্দা মেমনু মারমা (২৮) বলেন, গত তিন দিন ধরে আমাদের বাড়ি পানিতে ডুবে আছে। পাড়ার উপরে প্রতিবেশির বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। টানা বৃষ্টির কারণে স্রোতের পানিও ঘোলা। বৃষ্টির আগে আমাদের গ্রামে একটি গভীর টিউবওয়েল ছিল যেখান থেকে আমরা খাওয়ার পানি পেতাম। এখন সেটিও পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় খাওয়ার পানিরও সংকট।

আলীকদম উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম জানান, মাতামুহুরী নদীর পানিতে সড়ক প্লাবিত হয়ে আলীকদমে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। বলা চলে পুরো দেশের সঙ্গেই জেলার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর বলেন, বান্দরবান শহর অর্ধেক অংশ পানিতে তলিয়ে গেছে।

বান্দরবানসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলাগুলো অল্পবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা বা বন্যা কবলিত হওয়ার কারণ জানতে চাইলে উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, পাহাড়ে ঝিরি-ঝর্ণা ও শহর এলাকায় অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে পাহাড়ে গাছপালা আগের মতো নেই। ফলে অল্প বৃষ্টি হলেই পাহাড়ের পানির ঢলের সাথে মাটি-বালি চলে এসে নদীতে জমে নদীর ন্যাব্য কমে যায়। যার কারণে অল্প বৃষ্টিতেও সে পানি যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।

এছাড়া শহরে যে মেইন ড্রেনেজ ব্যবস্থা ছিল, সেটা নানান ভাবে দখল-করে অপরিকল্পিতভাবে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ঘরবাড়ি নির্মাণ করছে। ফলে একদিকে নদীর নাব্যতা কমে গিয়ে পানি উপচিয়ে পড়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। তেমনি অন্যদিকে শহরে মেইন ড্রেনেজ ব্যবস্থা দখল হয়ে ড্রেইনটাকে সংকুচিত করে ফেলছে। সব মিলিয়ে বান্দরবান শহরে জলাবদ্ধতা হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ বলে আমি এ দুটোকে মনে করি, বলেন তিনি।

দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রশাসন থেকে ১৯২টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। তবে কেন্দ্রগুলোতে ঠিক কতজন আশ্রয় নিয়েছেন, মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকায় তা জানা সম্ভব হয়নি।

এ প্রসঙ্গে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রোমেন শর্মা জানান, বান্দরবান জেলা সদরসহ অন্যান্য উপজেলার মতো নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ভারী বৃষ্টিপাত হয়নি। গত দুদিন ধরে কিছুটা ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। এখনো জলাবদ্ধতা হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। তবে পাহাড়ি ঝিরি-ঝর্ণা থেকে ঢলে আসা পানি কিছুটা সময় জলাবদ্ধতা থাকলেও বৃষ্টি কমে যাওয়ার সাথে সাথে পানিও কমে যায় বলে জানান এই কর্মকর্তা।

এদিকে, জেলা আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গত সাত দিনে জেলায় সর্বমোট ৯০৩ মিলিলিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে এবং সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ২৬৮ মিলিলিটার।