বিদেশে নারীদের কর্মসংস্থানে গুরুত্ব পাচ্ছে প্রশিক্ষণ-নিরাপত্তা

নারী শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাঠাচ্ছে সরকার। এদের বড় একটা অংশ কাজ করছে গৃহকর্মী হিসেবে। পোশাক খাতের শ্রমিকরাও আছেন এই তালিকায়। বছরে এক লাখের বেশি নারী এসব পেশায় কাজ করতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সৌদি আরব হচ্ছে তাদের প্রধান গন্তব্যস্থল। সেখানে তারা গৃহকর্মীর পেশায় কাজ করবেন। আর একটি অংশ যাচ্ছেন জর্ডানে, তারা কাজ করবেন পোশাক খাতে।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বাংলাদেশ থেকে ১৯৯১ সালে প্রথম নারী কর্মীরা বিদেশে যাওয়া শুরু করেন। সে বছর বিদেশে যান ২,১৮৯ জন নারী কর্মী। সেই হিসেবে এ বছরের জুন পর্যন্ত ১১ লাখ ৪৮ হাজার ১৪৮ জন নারী কর্মী বিদেশে গেছেন।

মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের প্রথম ৬ মাসে ৪২ হাজার ২২৬ জন নারী কাজ করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বছর শেষে এবার বিদেশগামী নারী কর্মীর সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে। বিদেশগামী কর্মীদের প্রধান গন্তব্য সৌদি আরব হলেও জর্ডান, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, লেবানন, যুক্তরাজ্য এবং মরিশাসে যাওয়া নারী কর্মীদের সংখ্যা আগের চেয়ে বেশি। এছাড়া মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইতালি, হংকং, সাইপ্রাসেও নারীরা কাজ করতে যাচ্ছেন। গেল দুই বছর থেকে কিছু নারী যাচ্ছেন ব্রুনেই, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায়।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, মোট নারী কর্মীর ৭০ শতাংশই যাচ্ছেন সৌদি আরবে। আর ৯ শতাংশ করে যাচ্ছেন জর্ডান ও ওমানে।

বিদেশে গমনেচ্ছু নারীদের প্রশিক্ষণ

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গৃহকর্মী পেশায় সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতে যেতে চাওয়া নারী কর্মীদের গৃহস্থালি কাজের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। গন্তব্য, দেশের ভাষা, আইন, খাদ্যাভ্যাস, স্বাস্থ্য ও সামাজিক রীতিনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের ধারণা দিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। দেশের ৪৩টি কেন্দ্র তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। আগে ৩০ দিন মেয়াদী প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক থাকলেও ২ মাস আগে সরকার প্রশিক্ষণের মেয়াদ বাড়িয়েছে আরও এক মাস। ২০২১-২২ অর্থবছরে ২২ হাজার ৬২৭ জন নারী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। তাদের যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে সনদ দেওয়া হচ্ছে।

বিদেশগামী নারী কর্মীদের সুরক্ষার জন্য সরকার ‘নারী কর্মী সুরক্ষা সেল’ গঠন করেছে। বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোতে শ্রমকল্যাণ উইংয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে ‘সেফ হোম’। কোনও কারণে বিপদে পড়লে নারী কর্মীদের উদ্ধার করে এসব সেফ হোমে আশ্রয় দেওয়া হয়।

প্রবাসীকল্যাণ ও কর্মসংস্থান সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন জানান, ‘প্রশিক্ষণ ছাড়া নারীদের কেউ আর বিদেশে যেতেই পারবেন না। এ বিষয়ে আমরা জোর দিচ্ছি। আর বেশির ভাগ গৃহকর্মী পেশার নারী বিদেশে গেলেও জর্ডানে যাচ্ছেন প্রশিক্ষিত পোশাক কর্মীরা। জর্ডানে অন্তত ২৫ হাজার নারী পোশাক শ্রমিক রয়েছেন।’

বিদেশে গিয়ে বিভিন্নভাবে নারীদের নির্যাতনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আর এ কারণেই আমরা চাই, যারা বিদেশে যাবেন, তারা যেন যত দূর সম্ভব, শিক্ষিত হয়ে যান। বিপদে পড়লে কেউ যেন অভিযোগ হলেও করতে পারেন।’

সরকারিভাবেও বিদেশে নারী কর্মী প্রেরণ

প্রবাসীকল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একমাত্র রাষ্ট্রীয় জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসেল)। ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠান প্রথম বছরেই ৪২ জনকে বিদেশে পাঠিয়েছিল।

বোয়েসেল সূত্রে জানা গেছে, তাদের মাধ্যমে গত বছর জাপান, কোরিয়া, হংকং, কুয়েত, জর্ডান, মরিশাস, সেশেলস এবং ক্রোয়েশিয়ায় গেছেন বাংলাদেশের কর্মীরা। ২০২২ সালে বোয়েসেলের মাধ্যমে ১৮ হাজার ২৫৪ জন কাজ করতে বিদেশে গেছেন, যার ৮৫ শতাংশই নারী। বোয়েসেলের মাধ্যমে যাওয়া নারীদের মধ্যে ১৩ হাজার ৭৫৭ জনের এক টাকাও খরচ হয়নি।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী জানান, দুটি বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ। একটি হচ্ছে নারীদের বিদেশে কাজ করতে যাওয়ার অধিকার, আরেকটি হচ্ছে তাদের সুরক্ষা। অধিকার কোনওভাবেই খর্ব করা যাবে না। তবে সুরক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে অনেক কিছু করার আছে।

তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, যে টাকা খরচ করে নারীরা বিদেশে যান, কয়েক মাসের মধ্যেই নারীরা তা রোজগার করে দেশে পাঠাতে পারেন। অথচ পুরুষ অভিবাসীদের অনেক ক্ষেত্রে এ রোজগার করতে দুই বছরও লেগে যায়। দেশের মোট প্রবাসী আয়ের অন্তত ৫ শতাংশ অভিবাসীদের সেবা দিতে বরাদ্দ রাখা চাই। এখন তা আছে দশমিক ১৪ শতাংশ।

সুরক্ষা বিষয়ে তিনি আরও বলেন, বিদেশে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে নারীরা একটা নির্দিষ্ট জায়গায় সাক্ষাৎ করতে পারলে কিংবা সাক্ষাৎ করতে না পারলেও টেলিফোনে কথা বলার সুযোগ তৈরি করতে পারলে তাদের সুরক্ষা অনেকটা বাড়বে। কাজটির সমন্বয়ে অবশ্য দূতাবাসকে যুক্ত থাকতে হবে।

তবে সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত থাকা অবস্থায় একাধিক গৃহকর্মীকে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সরকার একজন উপসচিবকে যে চাকরিচ্যুত করেছে, শুধু এই পদক্ষেপে সন্তুষ্ট নন তিনি। বলেন, প্রকাশ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে এ ধরনের অপরাধীদের।