১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকরা ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। এসময় বিদেশে থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা। বঙ্গবন্ধু হহত্যাকাণ্ডের পর স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে বাঙালি জাতির অস্তিত্বকে বিপন্ন করতে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু করে ঘাতকগোষ্ঠী।
বাঙালি।জাতির জীবনে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে ঘোর অমানিশার অন্ধকার। ঠিক এমনি ক্রান্তিলগ্নে ১৯৮১ সালের ১৪ ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁকে সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার পবিত্র দায়িত্ব অর্পণ করা হয় বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যার হাতে। বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বকে ভয় পায় ঘাতকগোষ্ঠী। খুনি সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করতে না দেওয়ার জন্য সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রিয় স্বদেশে ফিরে আসেন।
দীর্ঘ ছয় বছর পর নির্বাসন শেষে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখার জন্য সেদিন ঢাকা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ঢাকা শহর মিছিল আর স্লোগানে প্রকম্পিত হয়। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া আর প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টিও সেদিন লক্ষ লক্ষ মানুষের মিছিলকে গতিরোধ করতে পারেনি। কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও শেরে-বাংলানগর পরিণত হয় জনসমুদ্রে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখতে সেদিন সারা বাংলাদেশের মানুষের গন্তব্য ছিল রাজধানী ঢাকা। স্বাধীনতার অমর স্লোগান ” জয় বাংলা ” জয় বঙ্গবন্ধু ” ধ্বনিতে বাংলার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হতে থাকে। জনতার কন্ঠে বজ্রনিনাদে ঘোষিত হয়েছিল ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম-পিতৃ হত্যার বদলা নেব’ ‘ঝড় বৃষ্টি আঁধার রাতে আমরা আছি তোমার সাথে’ ‘শেখ হাসিনার আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম।’
দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নে দৃঢ় অঙ্গীকার, বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার, স্বৈরাতন্ত্রের চির অবসান ঘটিয়ে জনগণের হারানো গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সার্বভৌম সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ও সরকার প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা।
১৯৮১ সালের ১৭ মে ঝড় বাদল আর জনতার আনন্দাশ্রুতে অবগাহন করে শেরেবাংলা নগরে লাখ লাখ জনতার সংবর্ধনার জবাবে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতীর পিতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।’
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা ভাই রাসেল সকলকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি, আমি আপনাদের মাঝেই তাদেরকে ফিরে পেতে চাই। আপনাদের নিয়েই আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তা বাস্তবায়ন করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই, বাঙালি জাতির আর্থসামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি ছিনিয়ে আনতে চাই।’
মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃরুদ্ধার এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ১৯৭৫ এর পর ১৫ আগস্টের পর যখন প্রবঞ্চক বিশ্বাসঘাতক খুনি দেশদ্রোহীরা প্রিয় মাতৃভূমিকে ক্ষত-বিক্ষত করে তুলেছিল, জাতীর জীবন যখন জাতিদ্রোহীদের অত্যাচারে বিপর্যস্ত তখন শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল শ্রাবণের বারিধারার মতো পাহাড়সম বাধার বিপরীতে অনন্ত অনুপ্রেরণা। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে অশ্রু-বারিসিক্ত জন্মভূমিতে সংকটজয়ের বীজ রোপিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিনির্মাণের দৃঢ় প্রত্যয়ে প্রদীপ্ত অগ্নিশপথের রৌদ্রালোকে উদ্ভাসিত হয়েছিল বাঙালি জাতি।
ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নিরবচ্ছিন্ন দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম শুরু হয়। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে সামরিক জান্তা ও স্বৈরাশাসনের বিরুদ্ধে চলে তাঁর অকুতোভয় সংগ্রাম। জেল-জুলুম, অত্যাচার কোন কিছুই তাঁকে তাঁর পথ থেকে টলাতে পারেনি এক বিন্দু। শত প্রতিকূলতাতেও হতোদ্যম হননি কখনো।
বাংলার মানুষের হারিয়ে যাওয়া অধিকার পুনরুদ্ধার করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি বারবার স্বৈরাশাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সারা বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছেন। পরিশেষে আবির্ভূত হয়েছেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা রূপে।
আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের ৪২ বছরের রাজনৈতিক জীবনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বৈরাশাসকের অবসান, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বাঙালির ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে, গৃহহীন মানুষের মাথা গোজার ঠাঁই হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এবং একাত্তরের নরঘাতক মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্য সম্পন্ন এবং রায় কার্যকর হয়েছে।
শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্ব, যোগ্যতা, নিষ্ঠা মেধা মনন দক্ষতা, সৃজনশীলতা, উদার গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে এক সময় দারিদ্র্য দুর্ভিক্ষে জর্জরিত যে বাংলাদেশ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করতো, সেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বজয়ের অভিযাত্রায় এগিয়ে চলছে। বিশ্বসভায় আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুঁড়ির অপবাদ ঘুচিয়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে।
শেখ হাসিনার তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দক্ষতা মেধা ও গুণাবলীতে সমসাময়িক বিশ্বের অন্যতম সেরা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। আপন কর্মমহিমায় হয়ে উঠেছেন নব পর্যায়ের বাংলাদেশের নতুন ইতিহাসের নির্মাতা; হিমাদ্রি শিখর সফলতার মূর্ত স্মারক, উন্নয়নের কাণ্ডারী। উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের রূপকার, বাঙালির আশা আকাঙ্খার বিশ্বস্থ ঠিকানা, বাঙালির বিশ্বজয়ের স্বপ্ন সারথি। বিশ্ব রাজনীতির উজ্জ্বলতম প্রভা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পিছিয়ে পড়া দেশ জাতি জনগোষ্ঠীর মুখপাত্র হিসেবে বিশ্বনন্দিত নেতা।
বারবার মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা “নীলকন্ঠ পাখি” মৃত্যুঞ্জয়ী মুক্তমানবী। তিমির হননের অভিযাত্রী, মানবতার জননী, আত্মশক্তি সমৃদ্ধ সত্য সাধক। প্রগতি উন্নয়ন শান্তি ও সমৃদ্ধির সুনির্মল মোহনা। এক কথায় বলতে গেলে সাগর সমান অর্জনে সমৃদ্ধ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কর্মময় জীবন।
শেখ হাসিনার দীর্ঘ ৪২ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের এ পথচলা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না, ছিল কন্টকাময় ও বিপদসংকুল। গণমানুষের মুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলন সংগ্রাম করার অপরাধে তাঁকে বারবার ঘাতকদের হামলার শিকার ও কারা নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। কিন্তু তিনি বাংলা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নীতি আদর্শের প্রশ্নে ছিলেন পিতার মতোই অবিচল, দৃঢ় সাহসী, আপোসহীন।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনঃরুদ্ধার এবং মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের ইতিহাস বিনির্মাণের সূত্রক্ষণ ১৭ মে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। এদেশের মাটি ও মানুষের কল্যাণে বাস্তবায়ন করেছেন বহুমাত্রিক উদ্যোগ। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের প্রতি তাঁর অগাধ প্রেম এবং অক্ষয় ভালবাসাই হল রাজনৈতিক পথচলার শক্তি।
