বাংলাদেশের চিকিৎসাক্ষেত্রে দিনদিন বাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের প্রবণতা। এ অবস্থায় কার্যকারিতা হারানো ওষুধের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নাম। বেশিরভাগ রোগীর শরীরে যে অল্প কিছু সংখ্যক অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে, বাজারে প্রয়োজনের তুলনায় সেগুলোর সরবরাহ কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ ব্যবহারের সিদ্ধান্তই ওষুধের কার্যকারিতা নষ্টের মূল কারণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স বৃদ্ধির ফলে ২০৫০ সালে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় বাড়বে ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন আমেরিকান ডলার। আর প্রতিহত করা না গেলে ২০৫০ সাল নাগাদ প্রতি বছর এক কোটি মানুষ মারা যাবে শুধু কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের অভাবে।
অ্যান্টিবায়োটিক এক ধরনের জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, যার সত্যিকার অর্থে বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয়েছে ১৯৪০ সালে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম আশীর্বাদ এই অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার। এর অপর নাম হল অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল ড্রাগ। এটি এমন এক ধরনের ওষুধ যা মানুষ এবং পশু উভয়ের শরীরেই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত ইনফেকশনের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এক্ষেত্রে তারা হয় ব্যাকটেরিয়াদের মেরে ফেলে, নয়তো ব্যাকটেরিয়ার দৈহিক বৃদ্ধি ও বংশবিস্তার রোধ করে।
সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জ ডাঃ মনিরুল ইসলাম জানান, সঠিক পরিমাণে এবং পর্যাপ্ত সময় ধরে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করলে ব্যাক্টেরিয়াগুলো পরোপুরি ধ্বংস না হয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তখন এই ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে ওই অ্যান্টিবায়োটিকের আর কোনো প্রভাব থাকেনা। এ অবস্থাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বলা হয়ে থাকে। হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে প্রতিদিনই আমরা সংকটাপন্ন এমন কিছু রোগীকে পাই যাদের শরীরে কাজ করছে না বেশিরভাগ অ্যান্টিবায়োটিক। এছাড়া বাজারে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের সরবারহও প্রয়োজনের তুলনায় কম। অধিকাংশ রোগীর রক্ত ও পরিক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, মাত্র ৩ থেকে ৪টি অ্যান্টিবায়োটিক এসব রোগীর শরীরে কাজ করছে, বাকি সব ওষুধ কোনো কাজেই আসছে না।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকার ফার্মেসি সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ফার্মেসিতে প্রতিদিন যে পরিমাণ ওষুধ বিক্রি হয় তার ২০ শতাংশই অ্যান্টিবায়োটিক। আর প্রায় ৫০ শতাংশ ক্রেতাই ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই কেনেন এসব ওষুধ।
বিক্রেতারা জানান, দুই-তিনদিনের সর্দি-জ্বর কিংবা কাশিতে ক্রেতারা ফার্মেসিতে এসে নির্দিষ্ট নাম ধরে ওষুধ চান। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই তাদের কাছে ওষুুধ বিক্রি করতে হয়।
তবে ক্রেতারা বলছেন, প্রায় সময়ই ডাক্তারের শরণাপন্ন হবার সুযোগ কম থাকায় জরুরি পরিস্থিতিতে নিজেরাই অ্যান্টিবায়োটিক কিনে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তারা।
প্রয়োজন ছাড়াই মানুষের মাঝে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করার প্রবণতা, এছাড়া সময় মেনে ওষুধ সেবন না করার কারণে মানুষের শরীরে জীবাণুরা একসময় শক্তিশালী হয়ে উঠে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা অর্জন করে।
এছাড়াও শরীরে আমিষের চাহিদা পূরণে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা মাছ, মুরগিসহ বিভিন্ন প্রাণির মাংসে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ নাজমুল ইসলাম বলেন, বিনা প্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করেছি। এছাড়া উপযুক্ত চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই যত্রতত্র ওষুধ ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, চিকিৎসা ব্যবস্থায় অতীব গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিবায়োটিকের এমন অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ভবিষ্যতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া যায়, প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় শুধু অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের কারণে, যেখানে বিশ্বের সব দেশই কম বা বেশি ক্ষতির শিকার।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও অন্যান্য প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলোকে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের একটি বাস্তবসম্মত নীতিমালা প্রণয়ন করে তার বাস্তবায়ন অতিজরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে রোগী এবং চিকিৎসক উভয়েরই সচেতন হওয়াটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ নাজমুল ইসলাম বলেন, ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোনও অবস্থাতেই ওষুধ বিক্রি করা যাবেনা। আর চিকিৎসকদেরও নিতান্ত প্রয়োজন ব্যতীত এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার কমাতে হবে। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি।
এছাড়া, সকল অ্যান্টিবায়োটিককে নির্দিষ্ট রং-এ চিহ্নিত করে দেয়া হবে এবং এই প্রক্রিয়াটি চলমান আছে। সকলের কাছে সহজ ও গ্রহণযোগ্য করতে প্রক্রিয়াটির বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। এর বাস্তবায়ন হলে দেশের মানুষ স্বাস্থ্যগত দিক থেকে বিরাট সুফল পাবেন।
(এই প্রতিবেদনটি বিএনএনআরসির তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্য সাংবাদিকতায় মিডিয়া ফেলোশিপের আওতায় তৈরি)