আইএমএফ ঋণের এপিঠ ওপিঠ

ইউক্রেন যুদ্ধ এবং কোভিড পরবর্তী জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি ও রফতানির বিপরীতে আমদানির পরিমাণ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির চাপে বাংলাদেশসহ আরো বেশকিছু দেশ ডলার সঙ্কটে পড়ে। এই ডলার সঙ্কটের কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ নিতে আবেদন করে। সে আবেদন মনজুর হয়েছে।

আইএমএফ এর ঋণের সুদের হার কম থাকলেও সব সময়ই শর্ত মানতে হয়। কোন কোন সময় সেসব শর্ত বেশ কঠিন হয় এবং তা ঋণ গ্রহীতা দেশের জনগণের উপর তার বিরূপ প্রভাব পড়ে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই আইএমএফ এর প্রস্তাবিত শর্ত মেনে কাঠামোগত সংস্কার করলে অর্থনীতি শক্ত ভিত্তি পায় এবং দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই হয়।

আইএমএফ এর অর্থনৈতিক মডেল এমন এক আদর্শ দেশকে কল্পনা করে বানানো যে দেশ খুব ছোট আর দক্ষ সরকার দেশ পরিচালনা করে জনগণের প্রত্যক্ষ করের টাকায়। সরকারি সব সেবা ভর্তুকি ছাড়াই নাগরিকদের পেতে হয়। ব্যবসা বাণিজ্য সব কিছু চলে মুক্ত অর্থনীতির নিয়মে। পশ্চিমা খুব ছোট গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সাথে এই মডেলের একটু মিল থাকলেও বাস্তবে এমন কোনো দেশ নেই।

এখন দেখা যাক বাংলাদেশের জন্য আইএমএফ এর প্রস্তাবিত শর্ত গুলো কী কী এবং সাধারণ মানুষের উপর তার সম্ভাব্য প্রভাব কেমন হতে পারে। বলে রাখা ভালো গণমাধ্যম থেকে শর্তের সূত্র নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আইএমএফ বা বাংলাদেশ এর কোনো অফিসিয়াল নথি পাওয়া যায়নি।

জ্বলানিতে দাম বাড়ানো এবং ভর্তুকি কমানো
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের প্রাথমিক কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বলানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়া। এক পর্যায়ে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১৪০ ডলার হয়ে যায়, যদিও এখন তা ৯০-১০০ ডলারের ঘরে। কিছু দিন আগে সরকার জ্বালানি তেলের দাম প্রায় ৫০% বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারের সমান বা তারচেয়ে একটু বেশি করে। তাই বলা যেতে পারে তেলের দাম নিয়ে আপাতত চিন্তার কিছু নাই।

সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানো এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকের সুদের হার বাড়ানো
বাংলাদেশের নিম্ন মধ্যবিত্ত, অবসরভোগী, বিধবা, বয়স্ক জনগোষ্ঠির জন্য আলাদা কোনও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। সঞ্চয়পত্র অনেকটা সেই সামাজিক সুরক্ষা দেয়। সুদের উপরে অনেক পরিবার নির্ভরশীল। সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানো হলে এদের জন্য তা হবে অমানবিক। তবে সরকার এর মধ্যে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার পুনর্গঠন করেছে, যদিও তা সাধারণ ব্যাংক রেট থেকে এখনো একটু বেশি তবে, যদি ব্যাংকের সুদের হার সুদের হার বাড়ানো প্রস্তাব করা হয় তাহলে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানোর আর কোন যুক্তি থাকে না। বাণিজ্যিক ব্যাংকের সুদের হার বাড়ানো হলে বাজারে তারল্য কমবে মুদ্রাস্ফীতি ও কমে যাবে আশা করা যায়। কিন্তু তাতে কর্মসংস্থান ও দেশের অর্থনীতি ধীর হয়ে যাবে। দেশের অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সুদের হার সুদের হার বাড়ানোর পরিবর্তে মন্দ ঋণ কমানো এবং ব্যাংকিং খাত সংস্কারের কথা বলে আসছেন। তবে সেটা স্বল্পমেয়াদে অর্জন করা সম্ভব না।

রিজার্ভ হিসাবের পদ্ধতিগত সংস্কার
সরকার বলে থাকে আমাদের রিজার্ভ ৩৫ বিলিয়ন ডলার। যদিও সরকার এই রিজার্ভ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার অন্য কাজে ব্যবহার করেছে যা স্বল্প সময়ে ফেরত আনা সম্ভাব না। আইএমএফ এর পরামর্শ রিজার্ভ হিসাবে সচ্ছতা আনলে বিদেশি বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে নির্ভরযোগ্যতা বাড়াবে যা তা দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য ভালো। এটা সরকার এর রিজার্ভ হিসাবের পদ্ধতিগত সংস্কার যার স্বল্পমেয়াদে সাধারণ জনগণের উপরে তেমন প্রভাব নেই।

ডলার রেট বাজারের উপরে ছেড়ে দেয়া এবং ডলারের এক রেট করা
বাংলাদেশে ডলার রেট অনেকটা সম্পূর্ণভাবে বাজারের উপরে ছেড়ে দেয়া নয়। এখানে রফতানির তুলনায় আমদানী বেশি হয় তাই ডলার কৃত্তিমভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এটা বাজারের উপরে ছেড়ে দিলে এক লাফে তা ১৩০ -১৫০ টাকা হয়ে যাবে এবং মুদ্রাস্ফীতি আর এক ধাক্কা বাড়বে। এই মুহূর্তে এটা কারোরই কাম্য না। এখন এখানে আমদানি রফতানি রেমিটেন্স এইসব কাজ অনুযায়ী ৩-৪ টি আলাদা ডলারেরর রেট আছে, আইএমএফ শর্তে এগুলা এক রেটে আনলে প্রবাসী শ্রমিকরা যে রেমিটেন্স পাঠাতে প্রণোদনা পায় সেটা পাবে না। তবে আমদানি রফতানিতে আর্থিক ব্যবস্থাপনা ভালো হতে পারে।

মুদ্রানীতি ও মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশে কাঠামোগত সংস্কার
আইএমএফ চায় সরকার মুদ্রানীতি ও মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশে কাঠামোগত সংস্কার করুক এবং তা তিন মাস অন্তর প্রকাশ করুক। এই শর্ত কাঠামোগত উন্নয়ন করবে এবং তা দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য ভালো।

গ্যাস ও বিদ্যুতের ভর্তুকি প্রত্যাহার
বাংলাদেশ সরকার বিদ্যুত খাতে অনেক ভর্তুকি দিয়ে থাকে এখাতে অব্যস্থাপনাও অনেক। আইএমএফ এর শর্তে খুচরা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে এই মুদ্রাস্ফীতির সময়ে জনগণের উপরে মড়ার উপরে খাড়ার ঘা পড়তে পারে। এই মুহূর্তে এটা করা বাস্তবসম্মত না। তবে আইএমএফ এর শর্তে বিদ্যুত খাতের অব্যস্থাপনাও কমে গেলে তা দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য ভালো।

ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণ কমানো এবং সুশাসন আনা
এটা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি সংস্কার। এটা সঠিকভাবে করা গেলে বর্তমানের অর্থনৈতিক চাপ অনেকাংশে কমানো যাবে। সাধারণ মানুষ বা ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ীরা সহজে ঋণ পেতে পারে ব্যবসার জন্য।

মোটাদাগে এই সব শর্তের কথা জানা যায়। এখন প্রশ্ন হল মঞ্জুরীকৃত ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ কি বর্তমান অবস্থা থেকে দেশকে তাৎক্ষণিকভাবে চাপমুক্ত করতে পারবে? এই সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার একবারে পাওয়া যাবে না। নিদিষ্ট সময় পর পর প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ সাপেক্ষে পাওয়া যাবে। সে অর্থে এই ঋণের তাৎক্ষণিক আর্থিক প্রভাব কমই। তবে এই ঋণ পাওয়ায় অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিনিয়োগের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর আস্থা রাখতে সাহায্য করবে, যা এই মুহূর্তের চাপ অনেকটা কমিয়ে আনবে।

লিখেছেন: সজীব সেন, একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কারিগরি উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত।