শিশুদের আকৃষ্ট করতে ফেরিওয়ালা থেকে শুরু করে সুপারশপ সব জায়গায় নানা ধরনের শিশুদের খাবার। অভিভাবকরাও এসব খাবার কিনে খাওয়াচ্ছেন সন্তানদের। মোটাদাগে বাংলাদেশের সার্বিক চিত্র এমনই।
সববচেয়ে ভয়ের বিষয় হলো- এসব খাবারের সাথে যেসব ক্ষতিকর উপাদান মেশানো থাকে সেগুলোর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলছে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে শিশুরাও পেটের পীড়ার পাশাপাশি কিডনি, লিভারসহ শরীরের বিভিন্ন সমস্যার শিকার হচ্ছে শুধু এসব খাবার খেয়ে।
দেশের রাজধানীসহ গ্রামের মুদি দোকান, সবখানে বিক্রি হচ্ছে মানহীন নানা ধরনের শিশুখাদ্য। ক্ষতিকর কেমিক্যাল, রং, কৃত্রিম ফ্লেভার ও ভেজাল উপাদানে তৈরি হচ্ছে দুধ, জুস, চকলেট, জেলিসহ হরেক রকম শিশুখাদ্য। বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা, কখনো কখনো এসব সিলগালা করেও দেয়া হচ্ছে কিন্তু তাদের লাগাম যেন কিছুতেই টানা যাচ্ছে না।
সচেতনতার অভাবে এসব খাবার কিনে আদরের সন্তানের মুখে তুলে দিচ্ছেন অভিভাবকরা। এতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে শিশুরা। বাজারের মানহীন, ভেজাল খাবারকে শিশুর খাবার হিসেবে কিনে থাকেন অভিভাবকরা। ইউনিসেফ বলছে, এই প্রবণতা শিশুর স্বাস্থ্য’র জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।
বাজারে বিক্রি হওয়া শিশুদের বিভিন্ন খাবারে থাকা ব্যাকটেরিয়া কিংবা এর থেকে উৎপন্ন হওয়া বিষাক্ত প্রতিক্রিয়ার কারণে শিশুর জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এছাড়া ভাইরাস এবং প্যারাসাইট বা পরজীবীর কারণেও খাদ্যে বিষক্রিয়া হতে পারে বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বিবিসি গুড ফুডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রক্রিয়াজাত কোন ধরনের খাবার শিশুদের না দেয়াই সবচেয়ে ভালো। এমনকি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ঝুঁকি থাকায় এক বছরের কম বয়সী শিশুকে মধু খাওয়াতেও নিষেধ করা হচ্ছে। তবে এক বছর বয়স হয়ে গেলে স্বাস্থ্যকর উপায়ে উৎপাদিত মধু খাওয়াতে পারবেন অভিভাবকরা।
ইউনিসেফ একটি প্রতিবেদনে বলছে, বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ২৮ শতাংশ খর্বকায় এবং ১০ শতাংশ কৃশকায়তায় ভোগে। যেসব শিশু অপুষ্টিতে ভোগে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং তাদের অন্যান্য রোগের সংক্রমণের ঝুঁকিও বেশি। তারা প্রায়শই একাগ্রতার সমস্যায় ভোগে এবং কোনও কিছুতে বেশি মনোযোগ দিতে পারে না। এ কারণে তাদের শিক্ষণ প্রক্রিয়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্য থেকে উদ্ভূত অসুস্থতাকে সংজ্ঞায়িত করে এভাবে ‘এমন একটি রোগ যা সংক্রামক বা বিষাক্ত প্রকৃতির এবং এটা এমন জীবাণুর মাধ্যমে হয় যা খাবার বা পানীয়ের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে।’
বাংলাদেশ ব্রেস্টফিডিং ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এসকে রায় বলেন, বাজারে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি শিশুখাদ্য পাওয়া যায়। যার মধ্যে ক্ষতিকর উপাদান ছাড়া কোনও ধরনের পুষ্টি থাকে না। তিনি আরও বলেন, শিশুর ছয় মাস পর্যন্ত মায়ের দুধ ছাড়া আর কোনও খাবার লাগে না। কিন্তু অনেক সময় অভিভাবকরা না জেনে বাজারে পাওয়া বিভিন্ন ধরনের দুধ শিশুদের খাওয়ান। এতে শিশুর পেটে সমস্যা হয়। এছাড়া আটা ও কিছুটা গুঁড়া দুধের সঙ্গে কয়েক ধরনের কেমিক্যাল দিয়েও শিশুখাদ্য তৈরি করে বাজারজাত করা হয়। তাই শিশুকে বাড়িতে তৈরি করা খাবার খাওয়াতে হবে।
শিশু বিশেষজ্ঞরা জানান, এখন শিশুদের মধ্যে কিডনি, লিভার ও স্নায়ুরোগ ব্যাপক মাত্রায় বাড়ছে। নানা রঙের চিপস, চকোলেট এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার এর জন্য বিশেষভাবে দায়ী।
এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিডনি বিশেষজ্ঞ ডা. সালমা জাহান বলেন, রঙ মিশিয়ে তৈরি খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করলে ধীরে ধীরে কিডনি ও লিভারের জটিল রোগ্যব্যাধি এবং ক্যান্সারসহ বিভিন্ন মরণব্যাধিতে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য পুষ্টি ইনস্টিটিউটের ক্লিনিশিয়ান ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ডা: মুরাদ মোহাম্মদ খান জানান, জন্মের প্রথম দিন থেকে দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর সার্বিক বিকাশে মায়ের দুধের কোনও বিকল্প নেই। এই বয়সের পর শিশুদের যথাসম্ভব বাড়িতে তৈরি খাবারে অভ্যস্ত করতে অভিভাবকদের পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ। শিশুকে বাড়ির বাইরের খাবার না খাওয়ানোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেন তিনি। জানান, এ বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন করতে অচিরেই নেয়া হবে ব্যাপক কর্মসূচি।
এ প্রসঙ্গে ডায়েট কাউন্সিলিং সেন্টারের প্রধান পুষ্টিবিদ সৈয়দা শারমিন আক্তার জানান, বর্তমানে অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থাসম্পন্ন পরিবারগুলোর মধ্যে বাজার থেকে বেবিফুড কেনার অদ্ভুত অভ্যাস লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এসব খাবারের বেশিরভাগই শিশুর জন্য অনিরাপদ।
তিনি আরও জানান, ইনফ্যান্ট ইয়াং চাইল্ড ফিডিং নামে একটি পদ্ধতি রয়েছে। ১৮১ তম দিন থেকে শিশুকে বুকের দুধ ছাড়াও অন্যান্য খাবার দেয়া যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে এসব খাবারে চিনি কিংবা লবণ কোনটাই ব্যবহার করা যাবেনা।
এ প্রসঙ্গে পুষ্টিবিদ হাসান আলী বলেন, ছয় থেকে নয় মাস বয়সী শিশুদের মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি মাত্র ২৭০ কিলোক্যালরি দরকার হয়। নয় মাসের পর থেকে এক বছর পর্যন্ত ৪৫১ কিলোক্যালোরি ও এক থেকে দুই বছর বয়সী শিশুদের ৭৪৮ কিলোক্যালরি প্রয়োজন হয়। ২০ থেকে ২৫ মিনিটের মধ্যে শিশু যতটুকু খায় তাকে ঠিক ততটুকুই খাওয়াতে হবে। বেশি সময় ধরে খাওয়ালে খাবারের পুষ্টিগুণ থাকে না। অনেকেই শিশুকে ঘি খাওয়াতে চান। তবে শিশুর নয় মাস বয়সের আগে রান্না করার তেল দেয়াই সবচেয়ে ভালো।
পুষ্টিবিদরা বলছেন, শিশুকে যেকোনও নতুন খাবার দেয়ার সময় বুঝেতে হবে সে হজম করতে পারছে কিনা, কোনও সমস্যা হচ্ছে কিনা। কারণ এ বয়সে ডায়রিয়া হলে সেটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। অনেকে বাচ্চাকে বাজার থেকে কেনা সেরেলাক দিয়ে থাকেন। তবে পুষ্টিবিদরা বলছেন বাজার থেকে সেরেলাক শিশুকে না দেয়াই ভালো। ভাজা চালের গুঁড়া, ভাজা ডালের গুড়া, এক মুঠ গুড় আর খাবার তেল ও পানি মিশিয়ে সেরেলাক তৈরি করে শিশুকে খাওয়ানো যায়।
গবেষকদের মতে, শিশুদের খাবার কেনার সময় মা-বাবাকে সতর্ক থাকতে হবে। ছোটবেলা থেকে শিশুর খাবারে সোডিয়াম ও চিনির মাত্রা সঠিক পরিমাণে থাকলে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। তাই প্যাকেটের গায়ে পুষ্টির মাত্রা দেখে খাবার কেনার পরামর্শ দেন গবেষকরা। আর এসকল উপাদান বাজারে প্রচলিত শিশু খাদ্যগুলোতে সবথেকে বেশি মাত্রায় থাকে বলে জানান বিশেষজ্ঞর।
এছাড়াও অন্যের দেখাদেখি শিশুখাদ্য কেনার প্রতি অভিভাবকদের ঝোঁকের বিষয়টিও অন্য যেকোনও সময়ের তুলনায় বেড়েছে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই সবার আগে অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর বিষয়টিকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন তারা।