জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে দেশ ছেড়ে, দেশের মানুষ ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর পথে। দূর দূরান্তে থাকলেও তাদের মন পড়ে থাকে দেশের মাঠ ঘাট প্রান্তরে। দেশের মানুষ, দেশের খাবারের জন্য তারা উন্মুখ হয়ে থাকে সারাক্ষণ। দেশি খাবার আর দেশি স্বাদের জন্য অনেকেই বাড়ির আঙিনায় সবজি ফলায়। কিন্তু দেশি সবজির বীজ বিদেশ বিভূঁইয়ে খুব সুলভ না। দেশ থেকে বীজ নিয়ে আসার ক্ষেত্রে আইনের কড়াকড়ি আছে। অনেকে লুকিয়ে বীজ আনলেও বেশিরভাগ মানুষ এই ঝুঁকি নেন না। দেশি গ্রোসারিগুলোতে কিছু কিছু বীজ পাওয়া গেলেও সেটা নিতান্তই অপ্রতুল। তাছাড়া সব জায়গায় দেশি গ্রোসারিও নেই। তাই দেশি সবজির বীজের সংকট থেকেই যায়। এটা মাথায় রেখে বাংলাদেশি বেশ কিছু মানুষ নিজেদের উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন সিড ব্যাংক। যেখান থেকে শুধু মাত্র ডাক মাসুল দিয়ে বিনামূল্যে সবজির বীজ পেতে পারেন যে কেউ। সিড ব্যাংক ও গ্রুপের উদ্যোক্তাদের বরাতে বিস্তারিত জানাচ্ছেন দেবাশীষ রায়।
‘মাত্র কয়েক মাস আগের কথা। তখনও এই গ্রুপটা ছিল না। সারাদিন কম্পিউটারের সামনে দিন কাটাচ্ছি। কাজের ব্যস্তটা একটু বেশি। আড্ডাবাজি হচ্ছে না কোভিডের কারণে। আবার বাইরে ঠান্ডাও বেশি। ভাবছিলাম একটু কাজকর্মের ভেতরে থাকা দরকার। কী করা যায়? কিছু আউটডোর একটিভিটি করব আর সাথে গার্ডেনিং। এর মধ্যে হঠাৎ মনে হলো ফেসবুকে গ্রুপ করলে কেমন হয়। সবাই কি পছন্দ করবে? পোস্ট করবে? গ্রুপটাতে কি পজিটিভ এনার্জি ক্রিয়েট করবে? শেষমেষ ‘North American Bangladeshi Gardeners Club’ খুলে ফেললাম। এরপর শুরু করলাম বন্ধুদের অ্যাড করা। অনেকেই এগিয়ে আসলো। প্রতিদিন পোস্ট আসতে লাগলো। সবগুলো পোস্ট খুব মনযোগ দিয়ে দেখেছি। অনেকের সাথে বন্ধুত্বও হয়েছে। অচেনা থেকে হয়ে গেল চেনা, অজানা থেকে জানা। আস্তে আস্তে গ্রুপটা বড় হতে লাগলো। হয়ে গেল সবার ভাললাগার জায়গা।’
এই লেখাটা মনজুর রাশেদ তার শুরু করা গ্রুপে পোস্ট করেছিলেন ২ অগাস্ট, ২০২১ সালে। তখন গ্রুপের সদস্য ৩০০-এর আশপাশে। দেখতে দেখতে সেই গ্রূপের সদস্য এখন সাড়ে এগারো হাজারের বেশি। ব্যাকইয়ার্ডে বাগান করতে চান, বাগান ভালোবাসেন যারা, ভিড় করেছেন এই গ্রুপে।
৬ নভেম্বর, ২০২১-এ মোহাম্মদ মাসুদ রেজা গ্রুপে একটা প্রস্তাব রাখেন, “আমরা কি একটি সিড ব্যাংক/বীজ ভান্ডার করতে পারি না (সবাই এই বীজ ব্যাংকে তাদের অতিরিক্ত বীজ জমা দিবে) কেন এই প্রস্তবনা? কারণ আমার কাছে ৪০০/৫০০ ভালো জাতের সজিনা বীজ ও ৪০০+ কাফির লাইম বীজ আছে, যা আমি সত্যিকারের বাগানীদের মধ্যে বিতরণ করতে চাই কিন্তু আমার সমস্যা হলো কাঙ্খিত বাগানীদের সময়মত দিতে পারি না। এ সমস্যা শুধু আমার নয় অনেকেরই। আমার জানা মতে মাইনউদ্দিন, কামাল এবং আরো অনেকে প্রচুর বীজ বিনামূল্যে বিতরণ করেন। আমাদের নিজেদের প্রচুর ব্যস্ততা এবং কাঙ্খিত বাগান মৌসুমে সময় মতন বীজ বপনের/প্রাপ্তির জন্যই এই প্রস্তবনা। এখন কথা হলো কে নিবে এই দায়িত্ব? যে ব্যক্তি বছরে ৩০০+ (অনুমান) মেইল করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত তাকেই দেয়া বা নেয়া উচিত। প্রাপক মেইল খরচ বহন করলে ভালো দেখায় (সিড ব্যাংকের সব সিড অবশ্যই ফ্রি), কেউ এই দায়িত্ব নিলে শুধু একটি নীতি দরকার ‘সততা’, এই গ্রুপে দশ হাজার সদস্যদের মধ্যে প্লিজ যারা সত্যিকারের বাগান ভালোবাসেন এগিয়ে আসুন সিড ব্যাংকের দায়িত্ব নিতে, কোন নিয়ম কানুনের প্রয়োজন বোধ করলে যে কেউ পরামর্শ দিতে পারেন। আমার মতে শুধু একটি নীতি চাই ‘সততা।’
১২ নভেম্বর, ২০২১-এ সুরাইয়া সুলতানা পোস্ট করেন, ‘সিড ব্যাংক, ফ্রি সিড!’ আমাদের বাংলাদেশিদের ভাতের পাতে যদি একটু সজনে, একটু কাফির লাইমের পাতার ঘ্রাণ মাখা তরকারি, একটু সীমের ঝোল, লাউ-চিংড়ি থাকে, ইশ! কিন্তু ইচ্ছে থাকলেই সজনে/কাফির/দেশি লাউ/দেশি সবজির বীজ অনেকেই হাতের কাছে পাই না। এই পাওয়াটাই আপনার জন্য সহজ করবে NABGC-এর ‘সিড ব্যাংক’ যা একেবারেই ফ্রি! ফ্রি সজনে বীজ/কাফির লাইম বীজ রেডি টু গো নাউ! এই গ্রুপের অনেকেই আছেন যারা নিজেদের শত ব্যস্ততার মধ্যেও হাজার হাজার রিকোয়েস্ট ইনবক্স ঘেঁটে বের করে এন্ট্রি করে, বার বার পোস্ট অফিসে গিয়ে নিজের বাগানের অতিরিক্ত বীজ সদস্যদের সাথে শেয়ার করেন। আপনাদেরকে আর বারবার পোস্ট করার হ্যাসেল নিতে হবে না। সেই দায়িত্বটা এইবার সিড ব্যাংককে দিয়ে দিন। আমরা আপনার অতিরিক্ত বীজ অন্যদের কাছে পৌঁছে দিব। আপনার সহযোগিতা সীড ব্যাংকের চালিকা শক্তি। কী করে বীজ পাবেন? যখনি কারো পোস্টে বীজ দেখে নিতে ইচ্ছে হল কমেন্টে সিড ব্যাংক সদস্যকে ট্যাগ করুন। অথবা ভলান্টিয়ারের সাথে ইনবক্সে যোগাযোগ করুন, বীজ সংক্রান্ত তথ্য জানাবেন উম্মে জাহরা জাহীন, হাসিব সাইফ, কানিজ ফাতেমা। পাঁচ ডলার সিপিং চার্জ zelle একাউন্টে দিলেই কাক্ষিত বীজ কয়েক দিনের মধ্যে আপনার কাছে পৌঁছে যাবে। সিড ডোনেট করতে চান? আপনার অতিরিক্ত বীজ শেয়ার করতে চাইলে ইনবক্সে এড্রেস পাবেন ভলান্টিয়ারের কাছে। বীজ পাঠানোর পর সব দায়িত্ব আমাদের।’
সেই দায়িত্ব নিয়ে সীড ব্যাঙ্ক টিম তাদের শ্রম ও প্রচেষ্টায় নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত এক হাজারের বেশি বাগানীর কাছে তাদের কাঙ্খিত বীজ পৌঁছে দিয়েছেন। পুরো কাজটি করেছেন তারা স্বেচ্ছা শ্রমের ভিত্তিতে।
যুদ্ধ পরিস্থিতি, দ্ৰব্যমূল্যের চরম লাগামহীন গতি যখন মানুষের জীবনকে কোনঠাসা করে ফেলেছে, সেই সময় স্বেচ্ছাশ্রম ও ভালোবাসা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোটা ভীষণ জরুরি। সিড ব্যাংকের মতো ভালো উদ্যোগগুলো এই দুর্দিনে ভরসা যোগায়। আন্তরিক ধন্যবাদ নর্থ আমেরিকান বাংলাদেশি গার্ডেনার্স ক্লাব-এর উদ্যোক্তা, এ্যাডমিন প্যানেল, মডারেটর, সিড ব্যাংকের উদ্যোক্তা, ভলান্টিয়ার টিমকে। আপনাদের এই উদ্যোগ দীর্ঘ পথ চলুক, আরো সফল হোক।