নতুন বাজেটে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় বরাদ্দ থাকছে না

গেল জানুয়ারি মাসে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩ পাস হয়েছে। আর ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠনের প্রজ্ঞাপন হয়ে। তবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ এখনো গঠিত হয়নি। হয়েছে তাই সরকার এখনো সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালুর ব্যাপারে পুরোপুরি প্রস্তুত নয়।

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, সদস্যসহ ১৬ সদস্যের যে পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হওয়ার কথা, সেটিও হয়নি এখনো। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ কর্তৃপক্ষের জন্য একটি অফিসও খুঁজে পায়নি। তহবিল, কর্মসূচি ইত্যাদির জন্য যে বিধিমালা তৈরি হওয়া দরকার সেগুলোও হয়নি।

তবুও বর্তমান মেয়াদের শেষ বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল পরীক্ষামূলকভাবে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালুর ঘোষণা দেবেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানায়, প্রবাসী, বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক চাকরিজীবী, শ্রমিকশ্রেণি, অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তি, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিভুক্ত জনগোষ্ঠী ও শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা ছয় ধরনের কর্মসূচি করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ বিভাগ। অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, কাজটি অনেক জটিল। ২০২৮ সালের আগে সর্বজনীন পেনশন বাধ্যতামূলকভাবে শুরু করার বাস্তবতা নেই। তার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচি ঐচ্ছিক হিসেবে চলবে। নতুন অর্থবছরে এ ব্যাপারে কোনো বরাদ্দও থাকছে না বলেও জনান তিনি।
আইনেও বলা আছে, সরকার যতক্ষণ এটিকে সব নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশন ঐচ্ছিক থাকবে। সর্বজনীন পেনশনে ১৮ বছর বা এর বেশি বয়স থেকে ৫০ বছর বয়সী সব বাংলাদেশি নাগরিক অংশ নিতে পারবেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিরাও বিশেষ বিবেচনায় সুযোগ পাবেন। তবে আপাতত সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীরা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতাবহির্ভূত থাকবেন।

বর্তমানে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মচারীরা অবসরের পর পেনশন সুবিধা পান। আইনে বলা হয়েছে, সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতিতে সরকারি, আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও অংশ নিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের চাঁদার অংশ নির্ধারণ করবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ।

তবে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি না করা পর্যন্ত সরকারি ও আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীরা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত থাকবেন না। চাঁদাদাতাকে ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিতে হবে।

২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে জাতীয়ভাবে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা চালু করার ব্যাপারে নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার করেছিলেন
আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর জন্য ২০১৭-১৮ সালের বাজেট বক্তব্যে একটি রূপরেখা দিয়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’ চালুর বিষয়ে একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করে অর্থ বিভাগ। কৌশলপত্রে বলা হয়, বাংলাদেশে বর্তমানে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর তুলনায় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি থাকায় সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি শুরু করার এটাই প্রকৃত সময়। তারপরই এ বিষয়ক আলোচনা গতি পায়।

জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আনফান্ডেড, ফান্ডেড, ডিফাইন্ড বেনিফিটস (ডিবি), ডিফাইন্ড কন্ট্রিবিউশনস (ডিসি) এই চার ধরনের পেনশন পদ্ধতি চালু রয়েছে। আনফান্ডেড পেনশনে কোনো কর্মীকে চাঁদা দিতে হয় না বলে এটির জন্য কোনো তহবিলও সৃষ্টি হয় না। ফান্ডেড পেনশনে কর্মী বা প্রতিষ্ঠান বা উভয়কেই চাঁদা দিতে হয়। ডিবি পদ্ধতি সরকারি কর্মচারীদের জন্য। ডিসি পদ্ধতিতে কর্মী বা প্রতিষ্ঠান থেকে একটি তহবিলে অর্থ জমা হয় এবং সেখান থেকেই ব্যয় নির্বাহ করা হয়। কোনো কোনো দেশে অবশ্য বীমা কোম্পানির মাধ্যমেও পেনশনব্যবস্থা চালু আছে।

বিভিন্ন দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা যেমন:
অর্থ বিভাগের তৈরি করা কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী ভারতে ২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে জাতীয় পেনশনব্যবস্থা (এনপিএস) চালু করা হয়। শুরুতে সামরিক বিভাগ ছাড়া শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের জন্য চালু করা হয় এটি। গ্রাহক ও নিয়োগকর্তা বা সরকার নির্দিষ্ট পরিমাণে চাঁদা দেয় এনপিএসে, যা পরে লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করা হয়। এতে ৬০ বছর বয়সে অবসরে যাওয়ার সময় ৬০ শতাংশ অর্থ নগদে তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়। বাকি ৪০ শতাংশ অর্থ পেনশন প্রদানের সুযোগ তৈরি করা হয়।

ভারত ২০০৯ সালের ১ মে দেশের ভেতরে ও বাইরে থাকা ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী সব নাগরিকের জন্য পেনশনব্যবস্থা উন্মুক্ত করে। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্মীদেরও পেনশন-সুবিধায় অংশগ্রহণের ব্যবস্থা রাখা হয়। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবী এবং নিম্ন আয়ের নাগরিকদের জন্য ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে একটি এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে আরেকটি বিশেষ প্রকল্প হাতে নেয় ভারত। মাঝখানে ২০১৩ সালে সরকারি ব্যবস্থায় এনপিএস চালুর জন্য পেনশন তহবিল নিয়ন্ত্রক ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (পিএফআরডিএ) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ ছাড়া দেশটিতে বয়স্ক, প্রতিবন্ধী ও বিধবাদের জন্য সামাজিক পেনশনব্যবস্থাও চালু রয়েছে।


অর্থ বিভাগের কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, চীনে মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ কর্মক্ষম। দেশটিতে তিন ধরনের পেনশনব্যবস্থা চালু রয়েছে। শহরে কর্মরত ব্যক্তিদের জন্য আরবান পেনশন সিস্টেম (ইউপিএস), সরকারি ও আধা সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সিভিল ও পাবলিক সার্ভিস পেনশন সিস্টেম (সিপিএসপিএস) এবং গ্রামে বেসরকারি চাকরিতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য রুরাল পেনশন সিস্টেম (আরপিএস) চালু রয়েছে দেশটিতে। ইউপিএস বাধ্যতামূলক ও ঐচ্ছিক—দুই ধরনেরই রয়েছে। এদিকে সরকারি ক্ষেত্রে ডিবি এবং গ্রাম ও শহুরেদের ক্ষেত্রে ডিসি পদ্ধতি চালু রয়েছে চীনে।

ইউপিএসে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কর্মচারীর মূল বেতনের ২০ শতাংশ দেয়। আর কর্মচারী দেন তাঁর মূল বেতনের ৮ শতাংশ। আরপিএস সম্পূর্ণ অংশগ্রহণমূলক। এতে সরকার ও ব্যক্তি উভয় অংশই নির্দিষ্ট হারে অর্থ জমা করে, যা থেকে মাসিক পেনশন দেওয়া হয়। সিপিএসপিএস সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত হয়।

যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রীয়, পেশাগত, ব্যক্তিগত ও আনফান্ডেড—এই চার ধরনের পেনশনব্যবস্থা চালু রয়েছে বলে কৌশলপত্রে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, রাষ্ট্রীয় পেনশনেও রয়েছে রাষ্ট্রীয় অবসর ভাতা, সম্পূরক পেনশন ও পেনশন ক্রেডিট নামক তিনটি অংশ। রাষ্ট্রীয় অবসর ভাতার আওতায় যাঁদের বার্ষিক আয় ৯ হাজার ৫০০ পাউন্ডের বেশি, তাঁদের বাধ্যতামূলক চাঁদা দিতে হয় জাতীয় বিমায়। যাঁদের আয় রাষ্ট্র নির্ধারিত নিম্ন আয়সীমার নিচে, তাঁদের দেওয়া হয় সম্পূরক পেনশন। এটা ঐচ্ছিক। আর পেনশন ক্রেডিট হচ্ছে ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য, যাঁদের আয় কম।

যুক্তরাজ্যে পেশাগত পেনশন হচ্ছে কর্মীর বেতন থেকে ৩ শতাংশ এবং সরকার বা কোম্পানি থেকে ৫ শতাংশ জমা হওয়ার পদ্ধতি। এতে বিনিয়োগ করে যে মুনাফা হয়, সেই মুনাফার টাকাসহ পেনশন দেওয়া হয়। এ ছাড়া আনফান্ডেড পদ্ধতিতে পেনশন দেওয়া হয় সব সামরিক, সরকারি কর্মচারী এবং শিক্ষকদের। আর ব্যক্তিগত পেনশন হচ্ছে বিমা কোম্পানির মাধ্যমে পরিচালিত একটি পদ্ধতি।

আর যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা, চাকরিভিত্তিক, আনফান্ডেড এবং ব্যক্তিগত পেনশন। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তাপদ্ধতির আওতায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ৯৪ শতাংশ কর্মক্ষম লোক। গ্রাহকের কর ও ট্রাস্ট ফান্ডে জমা হওয়া অর্থ বিনিয়োগের মুনাফা থেকে এ পেনশন দেওয়া হয়। এ পদ্ধতিতে বছরে চারবার ১ হাজার ৪১০ ডলার করে জমা, অর্থাৎ ১০ বছরে ৫৬ হাজার ৬০০ ডলার জমা হলেই পেনশনের প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করা যায়। চাকরিভিত্তিক পেনশনের আওতায় কর্মী যা দেবেন, তার সমপরিমাণ দেবে সরকার বা কোম্পানি। এ ছাড়া আনফান্ডেড পদ্ধতি ও ব্যক্তিগত পেনশনব্যবস্থা যুক্তরাজ্যের মতোই।

অর্থ বিভাগের তৈরি করা কৌশলপত্রে আরও বলা হয়েছে, উন্নত দেশ হওয়ায় অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে বাজেট থেকে সবাইকে পেনশন দেওয়া হয়। জাপান, হংকং, কোরিয়া ও তাইওয়ানের পরিস্থিতিও উন্নত দেশগুলোর মতোই। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম পেনশন সংস্কার করছে। ফিলিপাইন, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াও অংশগ্রহণমূলক পেনশন পদ্ধতি শুরু করেছে।