দিনভর নাটকীয়তা শেষে সন্ধ্যায় ভুল স্বীকার রওশন এরশাদের

সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে পদ নিয়ে কাড়াকাড়ির দিনভর নাটকীয়তার পর বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ মঙ্গলবার বিকেলে ভুল স্বীকার করেন।

দলের নেতৃত্ব নিয়ে কয়েক মাস ধরেই জাতীয় পার্টিতে চলছে নানা টানাপোড়েন। এরই মধ্যে ভারত সফরে থাকা জি এম কাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে গতকাল মঙ্গলবার সকালে নিজেকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন রওশন এরশাদ।

দেশে ফিরে গত শনিবার রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আর ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির আমন্ত্রণে দেশটি সফরে গেছেন জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের।

এর মধ্যেই গতকাল মঙ্গলবার হঠাৎ করে নিজের স্বাক্ষর করা চিঠিতে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে সম্মেলন পর্যন্ত দায়িত্ব গ্রহণের ঘোষণা দেন রওশন। এমন ঘোষণার পর রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি হয় জাপায়। দুপুরে রওশনের পক্ষ থেকে পাঠানো বিবৃতির কোনও ভিত্তি নেই বলে দাবি করেন দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু।

সন্ধ্যায় রওশন এরশাদ জানিয়েছেন, ‘ভুলবশত এই চিঠি গণমাধ্যমে চলে গেছে। মূলত দলের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণের চিঠি দেওয়ার কথা ছিল।’ সকালের চিঠি সংশোধন করে নতুন চিঠি গণমাধ্যমে সরবরাহ করা হবে বলেও জানান তিনি। এ প্রসঙ্গে দলের সাবেক মহাসচিব ও রওশনপন্থি নেতা মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেছেন, ‘এই সিদ্ধান্ত না মানলে চুন্নুরা রাস্তায় নামতে পারেন।’

মঙ্গলবার রওশন স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আমি বেগম রওশন এরশাদ, এমপি জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কো-চেয়ারম্যান এই মর্মে ঘোষণা করছি যে, পার্টির সিনিয়র নেতাদের পরামর্শে ও সিদ্ধান্তক্রমে দলের গতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করলাম।’

বিজ্ঞপ্তিতে রওশন লেখেন, “গত বছরের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি, নানা ধরনের মামলা-মোকদ্দমা এবং দল পরিচালনায় ‘অযোগ্যতা ও অসাংগঠনিক আচরণের কারণে’ জি এম কাদেরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।”

এতে বলা হয়, ‘জাতীয় পার্টির একাংশের মেয়াদোত্তীর্ণ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। দলের চারজন কো-চেয়ারম্যান ও দুজন প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রধান পৃষ্ঠপোষককে ক্রান্তিকাল মোকাবিলায় ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।’

এতে এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, সালমা ইসলাম, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, নাসরিন জাহান রত্নার স্বাক্ষর রয়েছে।

তবে বাবলা, কাজী ফিরোজ রশীদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে এই স্বাক্ষর তাদের নয় বলে জানিয়েছেন। আর জাপা’র বর্তমান মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, ‘যাদের নাম দিয়ে, স্বাক্ষর দিয়ে তারা এটা করেছেন, তাদের অনেকে জানেনই না।’

তিনি দাবি করেছেন, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও কাজী ফিরোজ রশীদের স্বাক্ষর জালিয়াতি করা হয়েছে। তারা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।

আর আবু হোসেন বাবলা এক বিবৃতিতে রওশনকে চেয়ারম্যান হওয়ার প্রস্তাবকারী হিসেবে তার নাম ব্যবহারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘জি এম কাদের এমপি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে বহাল আছেন। আমরা তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছি।’

জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর তার ভাই জি এম কাদের ও স্ত্রী রওশন এরশাদের মধ্যে দলের নেতৃত্ব নিয়ে বিভক্তি দেখা দেয়। সে সময় জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান ও রওশনকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়।

গত বছরের ৩১ আগস্ট হঠাৎ করেই এক চিঠিতে দলের কাউন্সিল আহ্বান করেন রওশন। তবে জি এম কাদেরের পক্ষ থেকে ওই পদক্ষেপকে ‘অবৈধ’ আখ্যা দিয়ে বলা হয়, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউন্সিল আহ্বানের ক্ষমতা শুধু চেয়ারম্যানের।

এরপর জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে মামলা করা হয়। দুপক্ষের দ্বন্দ্বের মধ্যে গত ১৩ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির দুই নেতা একসঙ্গে গিয়ে দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। সে সময় দুপক্ষের মধ্যে সমঝোতার কথাও জানানো হয়।

কয়েক মাস ধরেই জি এম কাদের সরকারের সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলের অবস্থান কী হবে, সে বিষয়টি এখনো স্পষ্ট করেননি তিনি।

আগামী জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভূমিকা কী হবে—তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলা নানা জল্পনা-কল্পনার মধ্যেই গত রোববার নয়াদিল্লি গেছেন জি এম কাদের। এর আগের দিন গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন রওশন।

এর তিন দিন পরই দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার কথা জানিয়ে রওশনের বিজ্ঞপ্তিটি আসে। এতে জানানো হয়, আসন্ন দশম জাতীয় সম্মেলন পর্যন্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন তিনি।

তবে সকালে নিজের স্বাক্ষর করা চিঠিতে জাপার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার কথা বললেও বিকেলে তা অস্বীকার করেছেন বিরোধী দলের নেতা ও দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘সকালের চিঠিতে দেওয়া স্বাক্ষর আমার। কিন্তু সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে এ চিঠিটি পাঠানোর কথা ছিল। ভুলবশত দলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের চিঠি গণমাধ্যমে চলে গেছে।’

১৯৯৯ সালে জাতীয় পার্টি বিএনপির সঙ্গে জোটে গেলেও ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে সে জোট থেকে বের হয়ে আসে। এ নিয়ে তখন দলে ভাঙন ধরে। বিজেপি নামে দল গঠন করে বিএনপি-জামায়াতের জোটে থেকে যায় একটি অংশ।

২০০৬ সালে বিএনপিবিরোধী আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয় জাতীয় পার্টি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জোটবদ্ধ হয়েই অংশ নেয়। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন না করার মনোভাব জানান এরশাদ। ওই সময় তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আর রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একাংশ নির্বাচনে অংশ নেয়।

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আবার আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে সমঝোতা হয়। আগেরবার দুই দল একসঙ্গে সরকার গঠন করলেও এবার জাতীয় পার্টিকে আর মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়নি।