তৃতীয় বর্ষেও জাবি শিক্ষার্থীদের কাছে ‘সোনার হরিণ’ আবাসিক হলের সিট

২০২০ সালের ১০ মার্চ এক বর্ণিল বসন্তে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নবীন ব্যাচের আগমন হয়েছিল ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের (৪৯ ব্যাচ) শিক্ষার্থীদের। দেশের একমাত্র শতভাগ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আগমনের প্রথম দিনেই অন্যান্য সুবিধার পাশাপশি আবাসিক হলে সিট পাওয়ার কথা ছিল তাদের। কিন্তু তিন বছর পার হলেও হলে আবাসিকতার সোনার হরিণের দেখা মেলেনি ৪৯ তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের।

লম্বা আয়তাকার একটি কক্ষের মেঝেতে সারি করে রাখা হয়েছে অর্ধশতাধিক বিছানা। শিক্ষার্থীদের কেউ এখানে শুয়েবসে আড্ডা দিচ্ছেন। কেউ বসে পড়াশোনা করার চেষ্টা করছেন। পর্যাপ্ত ফ্যান নেই, আছে আলোস্বল্পতাও৷ নেই কোনও পড়ার চেয়ার-টেবিল। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এভাবে প্রথম বর্ষের প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী সেখানে অবস্থান করছেন। একই অবস্থায় দিন কাটে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের। এরকমই চিত্র দেখতে পাওয়া যায়  জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্র হলে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য উদ্বোধন হওয়া দুটি নতুন হলসহ ছেলেদের নয়টি ও মেয়দের নয়টি মিলে ১৮টি আবাসিক হল রয়েছে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ছেলেদের দুটি ও মেয়েদের দুটি হলের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। নতুন হল চালু হলে আবাসন সংকট নিরসন হবে বলে প্রশাসন প্রতিশ্রুতি দিলেও আদৌ কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ  করতে পারেনি প্রশাসন। আবাসন সংকট দূর করে এবছর ৫১ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ক্লাশ শুরু করার কথা বললেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে অবৈধভাবে অবস্থানরত সকল অছাত্র-ছাত্রীদের হল থেকে অপসারণ করার প্রতিশ্রুতি রক্ষাতেও প্রশাসনের ব্যর্থতা লক্ষ্য করা যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো পরিদর্শন করে দেখা যায় গণরুমে দুর্বিষহ জীবন অতিবাহিত করছে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা। মওলানা ভাসানী হলে চার জনের একটি কক্ষে ১৫-২০ শিক্ষার্থী গাদাগাদি করে থাকছেন। এমনকি মিনি গণরুমে ১৪-১৫ জন করে থাকতে হচ্ছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে একটি কক্ষে প্রায় ৫০ করে শিক্ষার্থী থাকছেন। একই চিত্র ছেলেদের অন্য হলগুলোতেও লক্ষ্য করা গেছে। দূরদূরান্ত থেকে আসা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষার্থীরা যখন হলে থাকার ও পড়াশোনার মত উপযুক্ত পরিবেশ না পায় তখন অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ে ক্যাম্পাসের আশপাশে বাসা ভাড়া নিতে বাধ্য হন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাকিব হাওলাদার বলেন, শতভাগ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে প্রথম দিন থেকেই হলে একটি বৈধ সিট পাওয়ার কথা ছিল আমাদের। কিন্তু তৃতীয় বর্ষে এসেও আমরা এখনো মিনি গণরুমে আট থেকে ১০ জন করে থাকছি। পলিটিক্যাল ব্লকে সিনিয়ররা আরামে থাকে আর আমদের কষ্ট করে থাকতে হয়। প্রশানের এ ব্যাপারে আরও সোচ্চার হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

মীর মোশাররফ হোসেন হলের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শরীফ হাসান বলেন, অনলাইনে প্রথম বর্ষ শেষ করার পর ভেবেছিলাম দ্বিতীয় বর্ষে আর গণরুমে থাকা লাগবে না সিট পেয়ে যাব। কিন্তু থাকতে হচ্ছে সেই গণরুমেই। গণরুম থেকে বের হয়েই মিনি গণরুম। সেখানেও গণরুমের মত অবস্থা। তৃতীয় বর্ষে চাকরির জন্য পড়াশোনা শুরু করব ভেবেছিলাম। কিন্তু মিনি গণরুমে পড়াশোনার উপযোগী কোনও পরিবেশ নেই। পড়ার জন্য নেই কোনও চেয়ার টেবিল। গণরুমের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ একদিকে যেমন  আমাদেরকে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলছে তেমনি পড়াশোনাতেও ব্যঘাত ঘটাচ্ছে।

ছেলেদের আবাসিক হলগুলোতে প্রশাসনের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। সিট বরাদ্দের পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী। এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের, কিন্তু হলগুলোতে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দৃশ্যত কোনও ফলপ্রসু উদ্যোগ নেই।

গণরুমে শিক্ষার্থীরা যেখানে সিট সংকটে থাকার জায়গা পাচ্ছে না সেখানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আয়েশে থাকছেন। চারজনের কক্ষে থাকছে দুজন করে। এমনকি একটি কক্ষে মাত্র একজন করেও থাকছেন তারা। একাধিক কক্ষ দখল করে রাখারও অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। নবনির্মিত ২১ নম্বর হলেও প্রশাসনের চোখে ধোঁয়া দিয়ে অবৈধভাবে অবস্থান করছে ছাত্রলীগের কর্মীরা।

জাবিতে সিট সংকটের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা যায় হলগুলোতে অছাত্রদের অবস্থান, আসন বরাদ্দে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ না থাকা, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে আসন বরাদ্দের অলিখিত ক্ষমতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ অনুসারে স্নাতকোত্তর শ্রেণির মৌখিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাত দিনের মধ্যে আবাসিক হল ছেড়ে দিতে হয় শিক্ষার্থীদের। মেয়েদের আটটি হলে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ থাকায় সেটি সম্ভব হলেও ছেলেদের হলগুলোতে ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়া পরও অনেকেই হলে রয়েছেন।

গত সাত মার্চ রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত একটি অফিস আদেশে আগামী সাত দিনের মধ্যে নিয়মবহির্ভুত হলে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে প্রক্টর আ.স.ম ফিরোজ উল হাসান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে সবগুলো আবাসিক হলে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক হলের ছাত্রলীগকে জানানো হয়েছে। সাত দিন পর যদি নিয়মবহির্ভূতভাবে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা হল ত্যাগ না করে তাহলে হল প্রশাসন অছাত্রদের খুঁজে বের করে আইননত ব্যবস্থা নিবে।

নতুন হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সিট দখল সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেলকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, নতুন হলে ছাত্রলীগের কোনও কর্মী অবৈধভাবে থাকছে কিনা এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।