পশু নয়, পশুত্ব দমন কুরবানির মূল লক্ষ্য। ব্যক্তি স্বার্থকে কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগের অন্যতম মাধ্যম পবিত্র কুরবানি। শুধু দৃশ্যমান পশু নয় বরং এর মাধ্যমে আল্লাহ’র সন্তুষ্টি অর্জনই মুমিনের আসল লক্ষ্য। পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে কোরবানির গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেছেন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হুমায়রা রহমান সেতু।
ব্যক্তি স্বার্থকে কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করতে হবে
কোরবানি একটি প্রতিকী ব্যাপার। হজরত ইব্রাহিম (আ:) প্রিয় পুত্র ঈসমাইল (আ:) কে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি দিতে গিয়েছিলেন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। কিন্তু বর্তমান সমাজে মানুষের প্রিয় জিনিস হয়ে উঠছে তাদের ক্রোধ, হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, শত্রুতা, সুদ-ঘুষ এবং দূর্নীতি, যা মানুষের মনকে পশুতে পরিণত করছে। কোরবানির অর্থ কেবল পশু জবাই করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করাও এর একটি দিক। আল্লাহর মহব্বতে নিজের সকল অবৈধ চাহিদা ও পশুত্বকে কোরবানি করা। রাস্তার পাশে, রেললাইনের ধারে অনাহারে-অর্ধাহারে পড়ে থাকা মানুষগুলোর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া, অসুস্থদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, নিজের পাশের বাড়ির এতিম-অসহায় শিশুদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া। আমানত এবং ওয়াদা রক্ষা করা। বর্তমানে চলছে লাগামহীন এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় বিরামহীন ছুটে চলা। আমাদের সমাজে এখনো সত্যিকারের সাম্য, ভ্রাতৃত্ব এবং মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার প্রকৃত কারণ হচ্ছে আমরা পশু কোরবানি দিলেও আমাদের মনের ভেতরে লুকায়িত উপরিউক্ত কু-প্রবৃত্তি বিসর্জন দিতে পারিনি। এই পশুত্বই আমাদের মনের সকল মানবিক মূল্যবোধ ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাই শুধু লোক দেখানোর জন্য নয় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মানবিক মূল্যবোধ বৃদ্ধির তাগিদে নিজের পশুর কোরবানি দিতে হবে।
বি. এম. জুয়েল রানা, প্রভাষক, ফলিত গণিত বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।
জীবনে শুধু ভোগের নয়, ত্যাগের শিক্ষাও দেয় কোরবানি
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় কেবল প্রতিযোগিতা আর প্রতিযোগিতা। নেই কারোর জন্য সহমর্মিতা। যেখানে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইব্রাহিম (আ:) তার প্রিয় পুত্রকে কোরবানি দিয়েছিলেন, যা আমাদের জন্য ত্যাগের এক মহামান্বিত আদর্শ। এর মাধ্যমে বুঝে নিতে হবে মানুষের জীবন শুধু ভোগের জনমাধ্যম, ত্যাগের মহিমা সেখানে সমভাবে আসীন। মানুষ তার বৈধ স্বার্থ খুঁজবে, এতে দোষের কিছু নাই। কিন্তু সে অন্ধভাবে শুধু নিজের স্বার্থ খুঁজবে এটি কাম্য হতে পারে না। ভোগে আনন্দ নেই, ত্যাগেই প্রকৃত আনন্দ। এ শিক্ষাটি পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে। স্বার্থপরতা, হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, অহঙ্কার নিয়ে মানুষ আদর্শ মানুষ হতে পারেনা।
ডা: মো. শামসুর রহমান, সিনিয়র প্রভাষক (সার্জারি), ভেটেরিনারি এন্ড এনিম্যাল সায়েন্সেস অনুষদ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।
পশু কোরবানির মাধ্যমে সত্যানুসন্ধান ও মানবিক শুদ্ধতা প্রতিষ্ঠা
মনুষ্যত্ব বিবর্জিত বর্তমান সমাজ কলুষতা আর পাশবিকতায় নিমজ্জিত। দুর্নীতি, যুদ্ধ, বর্ণবাদ, পাশবিকতা ও পশুত্ব আমাদের সমাজ জীবনকে ঘিরে রেখেছে। যুব সমাজকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। যে শিক্ষা আমাদের অন্তরকে করবে পরিশুদ্ধ। যা আমরা পাই হযরত ইব্রাহিম (আ:) এর কাছ থেকে। যিনি কোরবানির মাধ্যমে আমাদের শিখিয়েছেন নিজের স্বার্থকে কীভাবে বলিদান করতে হয়। অহিংসা ও আত্মত্যাগের সমন্বয়ে মন থেকে ঘৃণা, ক্রোধ, বিদ্বেষ সরিয়ে ফেলতে হবে। আমরা যদি নিজেদের অন্তরের পশুকে দমন করতে পারি, তবেই ইসলামের আদর্শে মানবিকতাময় পরিশুদ্ধ সমাজ গঠন হবে।
আতিউন নাহার, প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।
কোরবানি নিছক পশু কোরবানি নয়, আত্মার পরিশুদ্ধি
কোরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য নিজের অহমিকা ও উচ্চাভিলাস বর্জন করা। পশুত্ব, আমিত্ব, অহমিকা, ঘৃণা, লোভ-লালসা ত্যাগ করে নিজের আত্মার পরিশুদ্ধি করা। কুরআনের ভাষায়, ‘পশুর রক্ত মাংস নয়, আল্লাহর কাছে পৌঁছাবে বান্দার তাকওয়া।’ ধর্মীয় অনুশাসনে ঈদের আনন্দ আজ শুধু লৌকিকতায় সীমাবদ্ধ। প্রতিযোগিতা করে চলে কোরবানি। মনের পশুত্বকে কোরবানি না করে লৌকিকতার প্রচন্ণ্ডতায় দগ্ধ সবাই।
মো. আল-আমিন হোসাইন, প্রভাষক, রাজনীতি ও প্রশাসন বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।