খাদ্যশস্যে স্বনির্ভর চাঁপাইনবাবগঞ্জ

আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রাচীন কাল থেকেই খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। পদ্মা ও মহানন্দা বেষ্টিত এ জেলার ভূমি চাষাবাদের জন্য বেশ উর্বর। জেলায় দুই লাখ ৮৯,০৯৩ হেক্টর জমিতে নানা ধরনের ফসলের আবাদ হয়। এরমধ্যে কিছু জমি এক ফসলী আবার কিছু জমিতে বছরে চারটি ফসলও হয়ে থাকে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রধান ফসল আম। জেলার ৩৭ হাজার ১৬৫ হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে। আর কুল, পেয়ারাসহ অন্যান্য ফলের চাষ হয় আরও দুই হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। সাম্প্রতি কমলা, মাল্টা, ড্রাগন ফলের চাষও শুরু হয়েছে। এছাড়াও জেলার উল্লেখযোগ্য ফসল হল ধান, সরিষা, আখ, মাসকালাই, মটর, খেসারি, বাদাম, গম, ভুট্টা। এছাড়া বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, শসা, মুলা, পটল, পেঁপে সহ বিবিধ সবজি চাষ হয়!।

জেলা সদরের রেজিস্ট্রি অফিস সংলগ্ন আড়ৎ ও কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে শীতকালীন সবজিসহ নানা রকম কৃষিপণ্য নিয়ে আসেন ব্যবসায়ীরা। অনেক জায়গা থেকে সরাসরি কৃষকরাও ফসল বিক্রি করতে আসেন।

আড়তের ব্যবসায়ীরা জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট, পুকুরিয়া, মনাকষা, চরবাগডাঙ্গা, রাণীহাটি ও লাভাঙ্গা ইউনিয়নের পার্শবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় ধান, মাসকালাই, পটল বেগুন, শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি চাষ হয়। সদর উপজেলার ইসলামপুর, কমলাকান্তপুর, হায়াতমোড় এলাকা থেকে সবজিসহ বিভিন্ন ফসল আসে এসব আড়তে। নাচোল ও গোমস্তাপুর উপজেলা থেকে মিষ্টি কুমড়া, শসা, পেঁপে, বেগুন, মালটা ও কমলা আসে।

আড়তের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ একাবউদ্দিন জানান, ভরা মৌসুমে প্রতিদিন ৩০০ মণের বেশি নানা রকম শাকসবজি আসে। কানসাট এলাকা থেকে এই মৌসুমে প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৮০০ মণ বেগুন রাজধানীতে পাঠানো হয়েছে। প্রায় ২০০ মণ পেঁপে, ফুলকপি, বাঁধাকপিসহ আরও প্রায় ২০০ মণ শাকসবজি চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে রাজধানীতে পাঠানো হয়। এছাড়াও মহানন্দা ও পদ্মা নদী থেকে জেলেদের ধরা মাছও ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।

তিনি বলেন, দ্বিতীয় মহানন্দা সেতু চালুর পর থেকে পদ্মা তীরবর্তী চরাঞ্চল থেকে খুব সহজে কৃষিপণ্য শহরের আড়তে নিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে, ফলে এলাকার চাষীরাও লাভবান হচ্ছেন।

আড়তের ফল ব্যবসায়ী আব্দুল হালিম বিগত চার বছর গোমস্তাপুর ও নাচোলের চাষীদের স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কমলা ও মালটা বিক্রি করেন। বাজারে এসব ফলের বেশ চাহিদা আছে।

নাচোল উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, এই উপজেলার বেশিরভাগ জমিতে এখন শীতকালীন সবজির চাষ করছেন কৃষকরা। উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের পঞ্চাশোর্ধ কৃষক তাজেমুল ইসলাম জানান, ১২ বছর বয়স থেকে কুলকপির চাষ করে আসছেন। প্রতি বিঘা জমিতে ফুলকপি চাষ করতে খরচ হয় আনুমানিক ১২ হাজার টাকা আর বিক্রি করে আয় করেন ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকার মত। তবে গেল কয়েক বছরে জমি সেচের খরচ, সার, বীজ, কীটনাশক, পরিবহন খরচ, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির কারণে কৃষকরা কম লাভবান হচ্ছে।

তিনি অভিযোগ করেন, নিয়মিত কপির চাষ করলেও কৃষি অফিসের কর্মকর্তাদের মাঠে কখনো আসতে দেখেননি। কপির ক্ষেতে পোকা বা রোগবালাইয়ের সংক্রমণ হলে কীটনাশক বাজারজাতকারী কোম্পানির প্রতিনিধিরা মাঝে মাঝে তাদের সাথে দেখা করে কীটনাশক কেনার পরামর্শ দেন।

এই এলাকার কৃষক তরিকুল ইসলাম বলেন, পাঁচ বিঘা আম বাগানে গেল তিন বছর থেকে মাসকালাই চাষ করছেন। এর মাধ্যমে প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার টাকা অতিরিক্ত আয় হচ্ছে তার।

সদর উপজেলার মহিপুরের কয়েকজন কৃষক বলেন, বর্তমানে জমি থেকে তারা আমন ধান কাটছেন। ধান উঠানোর পর এসব জমিতে সরিষার আবাদ করবেন। এছাড়াও বসতবাড়ির আঙ্গিনাতেও নানা রকম সবজি চাষ করেছেন তারা। এরমধ্যে শিম, লাউ, চাল কুমড়াসহ অন্যান্য সবজি রয়েছে।

দিয়াড়ধাইনগর গ্রামের শামীম হোসেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে ১৭ বিঘা জমি লিজ নিয়ে মাছের চাষ শুরু করেছেন। গোবরাতলা ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের পূর্ব পাশে তার মাছের পুকুর। পুকুরে কাতল, রুই, গ্রাস কার্পসহ বিভিন্ন জাতের মাছ রয়েছে।

গত দুই বছরে আট লাখ টাকা মুনাফা করেছেন শামীম। তার পুকুরের মাছ স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয়। এছাড়াও পুকুরপাড়ে কলাগাছ লাগানো হয়েছে। বছরে প্রায় দুই লাখ টাকার কলা বিক্রি করা যায়।

মাঠে কৃষি কর্মকর্তাদের উপস্থিতি না থাকা প্রসঙ্গে মুহূর্ত নিউজকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. পলাশ সরকার জানান, ‘আমাদের যে পরিমাণ লোকবল দরকার তার অর্ধেক লোকবল নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। ২৫ জন উপ-সহকারীর পদ থাকলেও আছে মাত্র ১২ জন। এরমধ্য দিয়েও সাধ্যমত সেবা দেয়ার চেষ্টা করি আমরা।’

তিনি বলেন, কৃষকরা সমস্যা হলে সরাসরি কৃষি কর্মকর্তাদের না জানিয়ে আগে কীটনাশকের দোকানে যায়। ফলে সমস্যা সমাধানের বদলে অনেক সময় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষকদের সব ধরনের পরামর্শ দিতে তারা তৎপর আছেন। সাধারণ কোনো সমস্যা হলে মুঠোফোনেও পরামর্শ দেয়া হয়। তবে বড় আকারে কোনো সমস্যা হলে কৃষি কর্মকর্তারা মাঠ পরিদর্শন করেই প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন। এছাড়া কৃষকরা ফসলের ক্ষেতে কী পরিমাণ রাসায়নিক সার ব্যবহার করবেন সে বিষয়েও সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। ফলে জমিতে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।

ড. পলাশ বলেন, আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আম, ধান, সরিষাসহ সবরকম ফল ও সবজির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আধুনিক চাষ পদ্ধতির সাথে জেলার কৃষকদের পরিচিত করতে কাজ করছে জেলা কৃষি বিভাগ।

আগামী বোরো মৌসুমে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ব্রি-৮৯ জাতের নতুন জাতের একটি ধান চাষের পরিকল্পনা করেছে কৃষি বিভাগ। এই জাতের ধান জমিতে প্রায় ৩৩ থেকে ৩৪ মণ ফলন হওয়া সম্ভব এবং এটি খেতেও অনেক সুস্বাদু।

এছাড়াও জেলার প্রতিটি পরিবারের ভোজ্য তেলের চাহিদা মেটানোর জন্য সয়াবিনের বদলে সরিষা তেল ব্যবহারের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। এজন্য বারি-১৪/১৫/১৭ বা বীনা সরিষা-৯ এর চাষ বৃদ্ধির জন্য তিন বছর মেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, বর্তমানে অনেক জমিতে নতুন করে আম বাগান তৈরি করা হচ্ছে। এগুলোতে সাথী ফসল হিসেবে সরিষা, মাসকালাইসহ স্বল্পমেয়াদী বিভিন্ন ফসলের চাষ করতে কৃষকদের উৎসাহ দেয়া হচ্ছে।

জেলার মানুষের জন্য বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি উৎপাদনের লক্ষে গোমস্তাপুর উপজেলায় ৩০০ বিঘা জমিতে একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এই প্রকল্পে ৩০০ জন কৃষক বিভিন্ন জাতের সবজি চাষ করেছেন।

বর্ধিত খাদ্য চাহিদা মেটাতে প্রতি পাঁচ বছর পর পর নতুন জাতের ফসল নিয়ে কাজ করছে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এরমধ্যে ফিলিপাইন থেকে আমদানী করা নতুন জাতে সুস্বাদু আখ, চায়নিজ কমলা, বিচিহীন লেবু, বারোমাসি তরমুজ চাষের প্রকল্প চলমান রয়েছে।

কৃষক, কৃষি কর্মকর্তা, আড়ৎদার ও কৃষি সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে কথা বলে এটা বলা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ আগামীর খাদ্য সংকট মোকাবেলায় প্রস্তুত! পার্শ্ববর্তী জেলা এবং রাজধানীর বাসিন্দারাও জেলার উদ্বৃত্ত ফসলের সুবিধা পাবেন!