কেজিতে ৫০০ টাকা পর্যন্ত দাম কোরবানির পশুর

কোরবানির ঈদ উপলক্ষ্যে রাজধানীর অদূরে কেরানীগঞ্জ বা মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকার পশুর খামারগুলোতে বেচাকেনা শুরু হয়েছে। প্রায় মাসখানেক আগে থেকেই এসব খামারে চলছে কোরবানির পশুর বিকিকিনি। খামারগুলো ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটিতেই ক্রেতারা আসছেন, পছন্দ করে কোরবানির জন্য গরু-ছাগল কিনছেন।

খামারিরা জানান, গত আট-দশ বছর থেকে কোরবানি উপলক্ষ্যে পশু লালন-পালন করছেন তারা। তারা বলছেন, ইতোমধ্যে তাদের প্রায় ৮০ ভাগ কোরবানির পশু বিক্রি হয়ে গেছে। তারা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জাতে গরু কোরবানিতে বিক্রির জন্য লালনপালন করেন।

মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ সংলগ্ন সাদিক এগ্রোতে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে ক্রেতারা এসে গরু দেখছেন, দরদাম করছেন, পছন্দ করে কিনেও নিচ্ছেন।

খামারে পশুর পরিচর্যার কাজে নিয়োজিত কর্মচারীরা জানান, মাসখানেক আগে থেকে তাদের খামারে বেচাকেনা শুরু হয়েছে। এখানে আসা ক্রেতারা নিয়মিত এই খামার থেকে পশু কেনেন।

খামারটির মালিক ইমরান হোসেন বলেন, বছর দশের আগে থেকে সাদিক এগ্রো’র খামারে কোরবানির পশু লালনপালন শুরু করি। এখানে যারা পশু কিনতে আসেন তাদের সাথে সম্পর্ক খুবই ভালো। তাই যারা একবার এখানে এসে কোরবানির পশু কেনেন, তারা বারবার এখানেই আসেন, অন্য কোনও পশুর হাটে যান না তারা।

তিনি আরও বলেন, ‘এখান থেকে কেউ গরু কিনলে ঈদ পর্যন্ত আমরা বিনামূল্যে যত্ন নিয়ে থাকি। ঈদের আগে ডেলিভারি চার্জ ছাড়াই ক্রেতার বাসায় পশু পৌঁছে দিই। প্রয়োজনে দুয়েকদিনের খাবারও সাথে দিই। এজন্য ক্রেতারা আমাদের ওপর আস্থা পায়’

বেড়িবাঁধ সংলগ্ন নিরালা ক্যাটেল ফার্মেও দেখা গেছে ক্রেতাদের আনাগোনা। অনেকেই পছন্দের কোরবানি পশু বুকিং করে রাখছেন। কেউ কেউ গরু কিনে বাড়ি ফিরছেন।

খামারের কর্মী আজহারুল বলেন, তাদের খামারে গরু ছাগল এবং ভেড়া মিলে চারশ’র মতো পশু আছে। ক্রেতারা পশু কেনার পর আমাদের কাছেই রেখে যেতে পারছেন, আমরা ঈদের আগ পর্যন্ত পশুর সব দায়িত্ব পালন করি। তাই ক্রেতারা হাটে না গিয়ে আমাদের খামার থেকে পশু কিনে থাকেন।

নিরালা ক্যাটেল ফার্মে কোরবানির পশু কিনতে আসা আকবর খান জানান, গত কয়েকবছর আগে থেকে এখানে গরু কিনতে আসেন তিনি। এবারও এখান থেকে গরু কিনবেন। দুটি গরু পছন্দ করেছেন, বুকিং করে যাবেন। ঈদের আগের দিন বিকেলে গরু বাসায় নিয়ে যাবেন তিনি।

সেখানে কথা হয় ক্রেতা শাহাদাতের সাথে। তিনি মিরপুর থেকে এসেছেন কোরবানির পশু কিনতে। জানান, এবারই প্রথম এখানে এসেছেন তিনি। তার বাজেটের মধ্যে ভালো মানের গরু পছন্দ হয়েছে তার। তাই এখান থেকেই এবার গরু কিনবেন শাহাদাত।

এবার কোরবানি পশুর মজুত-দাম দুটোই বেশি। খামারিরা জানান, পশুর খাবারের দাম বেশি বলে পশু কিনতেও খরচ বেশি হচ্ছে তাদের। গত বছরের তুলনায় এবার কোরবানির পশুর দাম বেড়েছে কমপেক্ষ পাঁচ শতাংশ। তারা বলছেন, ইতোমধ্যে অনলাইনেও পশু বিক্রি হচ্ছে তাদের। তবে শহরকেন্দ্রিক কোরবানির পশুর বেচাকেনা জমে উঠবে ঈদের দুয়েকদিন আগে।

বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ) বলছে, নির্বাচনের বছর হওয়ায় অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার পশু বিক্রি কিছুটা বাড়ার কথা। আবার অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বিবেচনা করলে মানুষের ওপর চাপ আছে। মানুষ খরচ কমাতেও পারে। তাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপক্ষো করতে হবে। তারা বলছেন, এবার পশুর দাম পাঁচ শতাংশের মতো বেড়েছে, তবে এর বেশি বাড়ার সম্ভাবনা কম।

বিডিএফএ জানিয়েছে, গত বছর জীবন্ত পশু ওজনের মাধ্যমে দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রতি কেজি ৪৬০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪৭৫ টাকা পর্যন্ত দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে এবার প্রতি কেজি ৪৮০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যমতে, এ বছর দেশে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর সংখ্যা এক কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩৩টি, যা গত বছরের চেয়ে চার লাখ ১১ হাজার ৯৪৪টি বেশি। এ বছর কোরবানির পশুর চাহিদা আনুমানিক এক কোটি তিন লাখ ৯৪ হাজার ৭৩৯টি। ফলে চলতি বছর কোরবানির পরেও দেশে ২১ লাখ ৪১ হাজার ৫৯৪টি পশু উদ্বৃত্ত থাকবে।

এবার কোরবানিযোগ্য পশুর মধ্যে ৪৮ লাখ ৪৩ হাজার ৭৫২টি গরু-মহিষ, ৭৬ লাখ ৯০ হাজার ছাগল-ভেড়া এবং দুই হাজার ৫৮১টি অন্যান্য প্রজাতির গবাদিপশু। তারমধ্যে ঢাকা বিভাগে আট লাখ ৯৫ হাজার, চট্টগ্রাম বিভাগে ২০ লাখ ৫৩ হাজার, রাজশাহী বিভাগে ৪৫ লাখ ১১ হাজার, খুলনা বিভাগে ১৫ লাখ ১১ হাজার, বরিশাল বিভাগে চার লাখ ৯৩ হাজার, সিলেট বিভাগে চার লাখ ১০ হাজার, রংপুর বিভাগে ১৯ লাখ ৬২ হাজার ও ময়মনসিংহ বিভাগে ছয় লাখ ৯৮ হাজার কোরবানিযোগ্য পশু প্রস্তুত আছে।

গত বছরের তুলনায় এবার গোখাদ্যের দাম ৩০ শতাংশের মতো বেড়েছে। ভুসি-খৈল দিয়ে প্রস্তুত করা গোখাদ্য প্রতি কেজি ৩২–৩৫ টাকা থেকে বেড়ে ৫০ টাকার আশপাশে বিক্রি হচ্ছে। পানি-বিদ্যুৎ বাবদ খরচও বেড়েছে আগের চেয়ে। ফলে বাজারে গরুর দাম পাঁচ শতাংশের মতো বাড়তি। খাসি বা অন্যান্য পশুর ক্ষেত্রে দাম আরেকটু বেশি বেড়েছে।

বিডিএফএ বলছে, গতবার লাইভ ওয়েট বা জীবন্ত পশু ওজনের মাধ্যমে দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রতি কেজি ৪৬০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪৭৫ টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছিল। এবার তা শুরু হয়েছে প্রতি কেজি ৪৮০ টাকা দিয়ে।

বিডিএফএ সভাপতি মো. ইমরান হোসেন জানান, গোখাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় এবার গরুর দাম স্বাভাবিকভাবে একটু বেশি থাকবে। তবে মানুষের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় গোখাদ্যের বাড়তি দামের তুলনায় পশুর দাম বাড়ানো যায়নি। তিনি বলেন, খামারিরা লাভের পরিমাণ কমিয়ে গরু বিক্রি করছেন।

এবছর অনলাইনেও কোরবানির পশুর বাজারও বেশ জমেছে। এবারও অনলাইনে ব্যবসায়ীরা ভালো বেচাকেনা করছেন। তবে এই পদ্ধতির বেচাকেনার বড় অংশই শহরকেন্দ্রিক। বিডিএফএ বলছে, এবার অনলাইনে গরুর তুলনায় খাসির চাহিদা বেশি। কারণ গরু অনলাইন থেকে কেনার চেয়ে হাটে এসে কিনতে চান ক্রেতারা। 

কোরবানির পশুর হাটে টাকা নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতারা নিরাপত্তা সঙ্কায় থাকেন। তাই এবার ঢাকা ও চট্টগ্রামের পশুর ১০টি হাটে ‘ক্যাশলেস’ বা নগদবিহীন লেনদেনের উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব হাটে নগদ টাকার পরিবর্তে কার্ডের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করে পশু কিনতে পারবেন ক্রেতারা।

কোরবানির পশুর এ ১০টি হাটে একটি করে ডিজিটাল বুথ থাকবে। সেখানে এটিএম থেকে টাকা ওঠানো যাবে। পয়েন্ট অব সেলস (পিওএস) যন্ত্র ও মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের (এমএফএস) মাধ্যমে ক্রেতারা পশু বিক্রির টাকা পরিশোধ করতে পারবেন। এতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের টাকা বহনের ঝামেলা থাকবে না।