কক্সবাজার উপকূলে মোখা আতঙ্ক, নিরাপদে সরানো হচ্ছে মানুষকে

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা কক্সবাজার উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে। আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, এটি বর্তমানে কক্সবাজার উপকূল থেকে ৮৬০ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ-দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছে। এর প্রভাবে সাগর উত্তাল রয়েছে। শনিবার সন্ধ্যা নাগাদ কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিনের কাছাকাছি উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগের প্রভাব পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। রোববার সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে ঘূর্ণিঝড়টি কক্সবাজার ও উত্তর মিয়ানমার উপকূল অতিক্রম করতে পারে বলেও জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

এদিকে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কায় শনিবার সকাল থেকেই সেন্টমার্টিনের স্থানীয় বাসিন্দাদের ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে আনা হচ্ছে। আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের সেন্ট মার্টিনের লোকসংখ্যা প্রায় ১১ হাজার। দ্বীপের অন্তত ৮ হাজার মানুষকে সরিয়ে আনার জন্য ইতোমধ্যে ৩টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রসহ দ্বীপের ৩৭টি হোটেল রিসোর্ট-কটেজ খালি করা হয়েছে।

দ্বীপের সর্বদক্ষিণের ৯ নং ওয়ার্ডের কোথাও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নেই। নেই পাকা ভবনের হোটেল রিসোর্টও। ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণপাড়া, হলবনিয়া, পুঁতকাটাবনিয়া, ডেইলপাড়াসহ ছয়টি গ্রামে প্রায় দুই হাজার মানুষের বসবাস। সকাল নয়টা থেকে সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে দক্ষিণপাড়া ও হলবনিয়া গ্রাম থেকে লোকজনকে সরানো কাজ শুরু হয়েছে। সঙ্গে আগেভাগে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাওয়ার জন্য এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে।

শনিবার দুপুরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কক্সবাজারে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। এছাড়াও চট্টগ্রাম ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৮ নম্বর মহাবিপৎসংকেত ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ৪ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের ১৩ নম্বর বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রবর্তী অংশ ও বায়ুচাপের পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারের দ্বীপ ও চরের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮ থেকে ১২ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।

দ্বীপে মোখা আঘাত হানবে এমন খবরে দ্বীপের বাসিন্দাসহ আশপাশের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় সেখানকার অনেকেই আগেভাগে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে টেকনাফে চলে গেছেন। ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হলে দ্বীপের অধিকাংশ ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যাবে। কারণ দ্বীপের ৯০ শতাংশ মানুষের ঘরবাড়ি ত্রিপলের ছাউনিযুক্ত, বাঁশ ও পলিথিনের বেড়ার।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড়ের আতঙ্কে ভুগছেন দ্বীপের হাজারো মানুষ। দুপুর ১২টা পর্যন্ত পরিস্থিতি গুমোট অবস্থায় থাকলেও লোকজন আতঙ্কে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। সেন্ট মার্টিন বাজারের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ রয়েছে।

এর আগে, গত বছরে ২৫ অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সময় সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ তলিয়ে গিয়েছিল। সে সময় শতাধিক ঘরবাড়ি ও বিপুল পরিমাণ নারিকেল গাছ উপড়ে পড়েছিল। ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাতের সময় সাগরে পূর্ণিমা ও অমাবস্যার জোয়ারের প্রভাব থাকতে পারে। তখন জোয়ারের পানির উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২৫ ফুট বেশি হতে পারে। তখন ক্ষয়ক্ষতিও বাড়তে পারে। জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর মতো টেকসই বেড়িবাঁধ সেন্ট মার্টিনে নেই।

স্থানীয়রা আরও জানান, ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে লোকজনকে সচেতন করতে শনিবার সকাল থেকে ইউনিয়নের ৯, ৮, ৭ নম্বর ওয়ার্ডে একাধিক স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর মাধ্যমে মাইকিং করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ঘূর্ণিঝড় মোখা দ্রুত ধেয়ে আসছে। আরও কাছাকাছি অবস্থানে চলে এলে লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে দ্রুত চলে যেতে হবে। তাই আগেভাগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, শুকনা খাবার নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে।

সকাল ১১টার মধ্যে সেন্ট মার্টিন হাসপাতাল ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন অন্তত ২০ পরিবারের ১০৪ জন। বেশির ভাগ নারী-পুরুষ। আশ্রয় নেওয়া লোকজনের দুপুরের খাবারের জন্য হাসপাতাল ভবনের নিচে কয়েকজন পুরুষ রান্নার আয়োজন শুরু করেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পরিবারের ছয় সদস্য নিয়ে হাসপাতালের তিনতলার একটি কক্ষে আশ্রয় নিয়েছেন দ্বীপের পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা মো. ইসমাইল (৫২)। তিনি বলেন, গত বছরের অক্টোবরে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে তার বাড়ি প্লাবিত হয়েছিল। তাই ঝুঁকি এড়াতে আগেভাগে আশ্রয়শিবিরে চলে এসেছেন।

ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সাগর উত্তাল থাকায় সেন্ট মার্টিন-টেকনাফ নৌপথে যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ আছে। সেন্ট মার্টিন সার্ভিস ট্রলার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সেন্ট মার্টিনের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে অবনতি হচ্ছে। সাগর উত্তাল হওয়ার পাশাপাশি জোয়ারের পানির উচ্চতাও বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে।

ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, পুলিশ সদস্যরা প্রস্তুত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান। তিনি জানান, সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ৩টি সাইক্লোন শেল্টারসহ ৩৭টি হোটেল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এসব জায়গায় সাত হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় নিতে পারবেন। মানুষকে সচেতন করতে এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় থাকা লোকজনকে আগেভাগে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে আনতে কাজ করা হচ্ছে। সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ শুকনা খাবার মজুত রাখা হয়েছে।