‘বিষে’ ভাতে বাঙালির আমিষ ভোজন!

দেশের জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা, প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মৎস্য চাষ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। গেল কয়েক বছর ধরেই দেশের চাহিদার তুলনায় মাছের উৎপাদন উদ্বৃত্ত থাকলেও নিরাপদ মাছ উৎপাদনের প্রেক্ষিত বিবেচনা করলে এই অর্জন অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ অতীতের যেকোনও সময়ের তুলনায় মাছ চাষে বেড়েছে একোয়া মেডিসিন বা রাসায়নিকের যথেচ্ছ ব্যবহার।

সাম্প্রতিককালে খাদ্য নিরাপত্তাযর বিচারে মাছ একটি ঝুঁকিপূর্ণ খাদ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে৷ কারণ মাছ চাষের সাথে জড়িত কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার আশায় একোয়া মেডিসিন বা রাসায়নিকের ব্যবহার করছেন মাত্রাতিরিক্তভাবে। মাছ চাষের ক্ষেত্রে পানিতে অক্সিজেনের সংকট; পানিতে এমোনিয়া ও হাইড্রোজেন সালফাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাস দূরীকরণ, মাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধিসহ যেকোনও ধরনের প্রতিকূলতা এড়াতে বিভিন্ন মেডিসিন ব্যবহার করা হয়। এসব ওষুধকেই মূলত একোয়া মেডিসিন বলা হয়। তবে এসব মেডিসিন পুকুরে প্রয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই যথাযত প্রয়োগবিধি ও সঠিক মাত্রা সমুন্নত রাখার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক খামারী ও ব্যবসায়ীরা সে নির্দেশনা মানছেন না।

গবেষকরা বলছেন, অল্প সময়ে অধিক লাভের আশায় পুকুর কিংবা জলাশয়ে অস্বাভাবিক মাত্রায় একোয়া মেডিসিনসহ অন্যান্য রাসায়নিক ব্যবহার করেন। আবার মাছ সংরক্ষণ ও বিপণনের সময়ও যথেচ্ছভাবে ফরমালিন ব্যবহার করছেন।

এ প্রসঙ্গে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক মাসুদ রানা পলাশ মুহূর্ত নিউজকে জানান, বর্তমানে মৎস্য চাষে চাষিরা জীবাণুনাশক (বিকেসি গ্রুপ), এন্ট্রিপ্যারাসাইটিক ড্রাগ (ডেল্ট্রামেথ্রিন গ্রুপ), ইনসেকটিসাইড/পোকানাশক (সুমিথিয়ন, টপ টেন), অক্সিজেন ট্যাবলেট (হাইড্রোজেন পার অক্সাইড), গ্যাস রিমোভার (সোডিয়াম লরাইল সালফেট) ব্যবহার করছেন।

তিনি আরও বলেন, জীবাণুনাশক (বিকেসি গ্রুপ) শতকে ৪-৫ ফিট গভীরতার জন্য ৫ মিলি, এন্ট্রি প্যারাসাইটিক ড্রাগ (ডেল্ট্রামেথ্রিন গ্রুপ) শতকে ৩-৪ ফিট গভীরতার জন্য ১-২ মিলি, ইনসেকটিসাইড/পোকানাশক (সুমিথিয়ন, টপ টেন) শতকে ৩-৪ ফিট গভীরতার জন্য শতকে ২-৩ মিলি, অক্সিজেন ট্যাবলেট (হাইড্রোজেন পার অক্সাইড) শতকে ৩-৪ ফিট গভীরতার জন্য ৫-৬ গ্রাম, গ্যাস রিমোভার (সোডিয়াম লরাইল সালফেট) শতকে ৪-৫ ফিট গভীরতার জন্য শতকে ৫ গ্রাম+জিওলাইট শতকে ২৫০ গ্রাম হারে ব্যবহার করছেন চাষিরা।

এ বিষয়ে তিনি আরও বলছেন, বর্তমান সময়ে চাষিরা মাছের খাদ্য ও মেডিসিন সংকটে পড়ছেন। এতে এটা অন্তত পরিষ্কার যে, মৎস্য চাষিরা এসব মেডিসিনের প্রতি ধীরে-ধীরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। এদিকে, কোম্পানিগুলোও খামারিদের চাহিদা অনুযায়ী যোগান দিতে নিজেদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। রোগসহ যেকোনও সংকটে মৎস্য চাষিরা বিভিন্ন কোম্পানির টেকনিক্যাল অফিসার ও মার্কেটিং কর্মকর্তাদের শরণাপন্ন হচ্ছেন। এছাড়াও তারা মেডিসিন বিক্রেতাদের থেকেও চিকিৎসা নেন। এক্ষেত্রে খুবই অল্প সংখ্যক মাছ চাষি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের কাছে যোগাযোগ করেন।

মাঠ পর্যায়ে দেশে মাছের খাবার উৎপাদনকারীদের সম্পর্কে এই গবেষক ভয়াবহ তথ্য দেন। তিনি জানান, ফিড কোম্পানিগুলোর টেকনিক্যাল অফিসার এবং অ্যাকোয়া মেডিসিন কোম্পানির টেকনিক্যাল ও মার্কেটিং অফিসারদের দেয়া তথাকথিত প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী চাষিরা রাসায়নিক ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছেন। তাছাড়া অ্যাকোয়া মেডিসিন ব্যবহার করায় উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তারা চাষিদের সঠিক ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে এবং কেমিক্যালমুক্ত মাছ চাষের জন্য ব্যাপকভাবে তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও অধিক উৎপাদনের আশায় চাষিরা অনিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অ্যাকোয়া মেডিসিন ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছেন। ফলে মাছের উৎপাদন ঠিকই বাড়ছে, কিন্তু তা খাদ্য হিসেবে মোটেও নিরাপদ থাকছে না।

এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য পুষ্টি ইনস্টিটিউটের ক্লিনিশিয়ান ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডাঃ মুরাদ মোহাম্মদ খান জানান, মাছ চাষে অনিয়ন্ত্রিত এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার মানবদেহের জন্য অনেক বেশি ঝুকিপূর্ণ হতে পারে। বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা জেনেছি, অনেক চাষি সঠিক ডোজ অনুসরণ না করেই পুকুরে একইসাথে একাধিক এন্টিবায়োটিক মেডিসিন বিক্রেতাদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োগ করছেন। তাছাড়া ব্লিচিং পাউডার, পটাশ জাতীয় রাসায়নিক পুকুরে ব্যবহার করেন কিন্তু এসবের কার্যকরিতা শেষ হওয়া আগেই বাজারে মাছ বিক্রি করেন। এমন মাছ খেলে মানবদেহে এন্টিবায়োটিক সংবেদনশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।

মাছ চাষ ও সংরক্ষণে রাসায়নিক পদার্থের এমন অনিয়মতান্ত্রিক ও যথেচ্ছ ব্যবহার মানব স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যেই বাজারে সহজলভ্য অ্যাকোয়া মেডিসিন কিংবা রাসায়নিকের অপব্যবহার নিয়ে জনমনে নানা রকম উদ্বেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পঁচনশীল খাদ্যের বাহ্যিক চেহারাতে টাটকা ভাব ও দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করার জন্য ফরমালিন ব্যবহার করছেন৷

এ বিষয়ে রামপুরা এলাকায় বসবাসকারী গৃহিণী সুমি আকতার জানান, তিনি একজন নিয়মিত ক্রেতা। রামপুরা কাঁচা বাজার ও ওয়াবদা রোড সংলগ্ন বাজার থেকেই মাছ-মাংস, তরকারিসহ সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে থাকেন তিনি। তবে বর্তমান সময়ে বাজার থেকে মাছ কেনার সময় তাতে এক ধরনের ঝাঁঝালো গন্ধ অনুভব করেন।

তিনি বলেন, ‘ইদানিং মাছে উটকো-ঝাঁঝালো এক ধরনের গন্ধ পাই। কিন্তু কোনও উপায় নাই তো আর! তবে পরিবারের কথা ভেবে ভয় হয়।’

ত্রিশোর্ধ্ব আরও একজন গৃহিণী হাসিনা আক্তারও মুহূর্ত নিউজকে একইরকম অভিজ্ঞতার কথা জানান। তিনি বলেন, বাজারে সবকিছুই ভেজালে ছেয়ে ফেলেছে। আমরা বলি মাছে ভাতে বাঙালি কিন্তু সেই মাছও আর খাবার হিসেবে নিরাপদ নয়। আমরা তাহলে খাবো কী?

যদিও এ সংক্রান্ত বাংলাদেশ গেজেট এর ১৪ নং অনুচ্ছেদের এক নং উপধারা অনুযায়ী মৎস্যখাদ্য ও পশুখাদ্যে এন্টিবায়োটিক, গ্রোথ হরমোন, কীটনাশক, ইত্যাদি ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কে বলা আছে। সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে, মৎস্যখাদ্য ও পশুখাদ্যে এন্টিবায়োটিক, গ্রোথ হরমোন, স্টেরয়েড ও কীটনাশকসহ অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা যাবে না। কোনও ব্যক্তি উপধারা (১) এর বিধান লংঘন করলে এই আইনের অধীনে তা অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে।

ঢাকার অদূরে কেরাণীগঞ্জের কিছু মৎস খামার ঘুরে আসে মুহূর্ত নিউজের প্রতিবেদক। সেখানে কথা হয় কয়েকজন খামারির সাথে। মাছ চাষে রাসায়নিকের ব্যবহার প্রসঙ্গে ঢাকার কেরানীগঞ্জের উদ্যোক্তা ও মৎস্য খামারি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: সিদ্দিক জানান, কয়েক বছর ধরে ছোট-বড় মিলিয়ে বেশ কয়েকটি পুকুরে মাছ চাষ করে আসছেন তিনি। প্রথম দিকে চাষ করতেন দেশি জাতের মাছ। তবে ঝুঁকি ও খরচের দিক বিবেচনায় লাভের অঙ্কটা তেমন আশানুরূপ না হওয়ায় ধীরেধীরে তেলাপিয়া ও পাঙ্গাস মাছের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তবে উপজেলা মৎস্য অফিসের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন তিনি। মৎস্য কর্মকর্তার নির্দেশনা মেনে নিয়মতান্ত্রিকভাবে পুকুরে রাসায়নিক কিংবা অ্যাকোয়া মেডিসিন প্রয়োগ করেন এই খামারি।

তিনি আরও জানান, এতে তার ঝুঁকি এবং খরচ প্রথম দিকের থেকে অনেক কমে এসেছে। পাশাপাশি লাভের দিক থেকেও নিজের সন্তুষ্টির কথা জানান মো: সাদেক। তবে, মুহূর্ত নিউজের সাথে আলাপকালে, বেশকিছু বিষয়ে খামারিদের আরও সচেতন হওয়া উচিৎ বলে মত দেন এই উদ্যোক্তা। মাছ দ্রুত বড় করতে বর্তমানে খামারিদের মধ্যে বিভিন্ন জেনেরিকের এন্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহারের প্রবণতার বিষয়টি নিশ্চিত করেন তিনি। জানান, অনেক খামারি আছেন যারা বিশেষজ্ঞের কোনও রকম পরামর্শ ছাড়াই এসব ওষুধ কিংবা রাসায়নিক পুকুরে প্রয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তারপরও এই প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এক্ষেত্রে বিক্রয় ও বিপণন সেবার নামে কিছু অসাধু উৎপাদক প্রতিষ্ঠানকেও দায়ী করলেন এই খামারি। তবে নিরাপদ মাছ উৎপাদনে খামারিদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে সরকারের বিশেষ গুরুত্ব দেয়া উচিৎ বলে মত দেন এই উদ্যোক্তা।

উদ্ভূত পরিস্থিতি প্রসঙ্গে মৎস্য অধিদপ্তরের মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ শাখার সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো: সিরাজুল ইসলাম জানান, আমরা বড় একটি চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি। অনেক মাছের প্রজাতি বিলুপ্তির পথে ছিল, সেসব মাছের প্রজাতিকে আবারও সংরক্ষণ করা গেছে। আমাদের জাতীয় উৎপাদন ক্ষমতাও একসময় আশঙ্কাজনক হারে কমে গিয়েছিল, কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে আমরা দেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়েও উদ্বৃত্ত উৎপাদন ক্ষমতা অর্জন করেছি। বর্তমান সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এই ক্ষেত্রটিকে ঢেলে সাজানো হয়েছে, এক এক করে সমস্যার সমাধানে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে অধিদপ্তর। এখন নিরাপদ মাছ উৎপাদনের দিকে জোর দেয়া হচ্ছে। এ  খাত সংশ্লিষ্ট ও গবেষকদের সাথে পরামর্শ ও পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে আমরা এগোচ্ছি। ইতোমধ্যেই এ সংক্রান্ত নতুন একটি নীতিমালা আসছে। আশা করি খুব শীঘ্রই আমরা উল্লেখিত সমস্যাগুলোকেও কাটিয়ে উঠতে পারবো। তবে সরকারের পাশাপাশি খাত সংশ্লিষ্ট ও সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে বলে জানান পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ শাখার জ্যেষ্ঠ এই কর্মকর্তা।

আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় প্রাণিজ আমিষের ৫৮ শতাংশের যোগান আসে মাছ থেকে৷ মাছ একটি সুস্বাদু আমিষ জাতীয় খাদ্য৷ এতে রয়েছে উন্নত ও সহজ প্রাপ্য আমিষ, আনসেচুরেটেড ফ্যাটি এসিড, অত্যাবশ্যকীয় ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, ভিটামিন, মিনারেল ও খনিজ লবণ৷

কেবল প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মেটানোই শেষ কথা নয়, শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে মাছের সাথে বাঙালির যে গভীর সম্পর্ক তা অটুট রাখতে চান সচেতন সমাজের প্রতিনিধিরা। বাঙালিয়ানার ঐতিহ্য এই মাছকে নিরাপদ খাদ্য হিসেবে পেতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ চান তারা।