জ্ঞান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আর জ্ঞান অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে বই। তবে, শুধুমাত্র পাঠ্যবই পড়ে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। জ্ঞানের পরিসীমা ব্যাপক। যা খুব সহজেই আত্মস্থ করা যায় না। প্রকৃত জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে পাঠ্যবই বহির্ভূত অন্য সকল বই পড়ার কোনও বিকল্প নেই।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদেরকেই দেখা যায় পাঠ্যবইয়ে ডুবে থাকতে। অথচ, এই পুঁথিগত বিদ্যা কখনো হৃদয়ে মনুষ্যত্বের দ্বার উন্মোচন করতে পারেনা। ফলশ্রুতিতে দেখা যায়, উচ্চতর ডিগ্রী নেওয়ার পরও অনেকের মধ্যে মানবিকতা, সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি, বিবেকবোধ, শিষ্টাচার, সহযোগিতা, সৌজন্যতা, সংস্কৃতিমনা, সুচিন্তা, মুক্তচিন্তার জাগরণ ঘটে না।
আচরণের পরিবর্তন না ঘটলে, চরিত্রে মাধুর্যতা না থাকলে, কথা-কাজে স্মার্টনেস না পাওয়া গেলে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে চতুরতার দৃষ্টান্ত না দেখা গেলে যেমন শিক্ষিত বলা যায় না তেমনি, মূল্যবোধ সম্পন্ন, নৈতিক গুণের অধিকারী না হলেও মনুষ্যত্ব বিকশিত মানুষ বলা যায় না। আসলে শিক্ষিত হয়েও মানুষ হতে না পারলে এ শিক্ষা মূল্যহীন। বাংলাদেশে পুঁথিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হার বাড়ছে। তবে সুশিক্ষার প্রসার হচ্ছে না।
অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব লাইব্রেরি থাকলেও তার পাঠক নেই বললেই চলে। প্রকৃত শিক্ষিত হওয়ার জন্য এখন আর কেউ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যায় না। বর্তমানে শিক্ষা গ্রহণ করা হয় পদবী পাশের নিমিত্তে। সার্টিফিকেট আর সিজিপিএ এর মাধ্যমে চলে চাকরির বাজারে ভয়ংকর প্রতিযোগিতা। শুধুমাত্র জীবিকা অর্জনের জন্য ব্যবহৃত এই পুঁথিগত বিদ্যা শিক্ষিত সমাজটাকে অধম করে রেখেছে। জীবনের নবদ্বার উম্মোচনের পথ যদি এই পুঁথিতেই আটকে থাকে তাহলে সমাজ কখনোই এগুবে না। একজন মনুষ্যত্ব বোধ-জ্ঞান সম্পন্ন প্রকৃত মানুষ হিসবে গড়ে উঠতে চাইলে অবশ্যই বই পড়তে হবে।
পুঁজিতন্ত্রের যাতাকলে পৃষ্ঠ এই সমাজ ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার নামে যে পুঁথি গিলার মোচ্ছব তৈরি করেছে তা শুধুমাত্র জাতিকে পঙ্গু করবে না একটি দেশকেই ধ্বংশের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে। চোখ মেললেই দেখা যায় স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি ক্ষেত্রেই চর্চা চলে মুখস্ত বিদ্যার। নোট, গাইড বা শিট যে যেভাবে পারছে গিলছে। কমিশন বাণিজ্য, চটকদার অফার, ফাঁকিবাজি সহজ করতে শিক্ষকেরাও বলি করছেন দেশের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারিদের। এটাই কি তবে জ্ঞান চর্চার নিয়ম? এরকম পুঁথিগত বিদ্যা চর্চা শুধু জীবনের পথকে পাড়ি দেয়ার জন্য। একজন মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নয়।
শিক্ষা কেবল মুখস্থ বিদ্যা না, পরিপার্শ্বিক বিষয়াদির সঙ্গে উদাহরণ সৃষ্টি করে জ্ঞান লাভ করাই হলো শিক্ষা। যে শিক্ষায় আনন্দ থাকবে, কৌতুহল থাকবে, নিত্য-নতুন নানা বিষয়ে জানার চরম স্পৃহা থাকবে। আর এসব তৈরি হয় বই পড়ার মাধ্যমে। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার ভঙ্গুর এই দশায় তাইতো শিক্ষার্থীরা শিক্ষায় কোনও আনন্দ খুঁজে পান না। ফলাফলে দেখা যায় বই পড়ার প্রতি তাদের আগ্রহও কম। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বইয়রে মাধ্যমে যে বিনোদন পাওয়া যায় তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। সম্পর্ক তৈরি করে দিতে হবে লাইব্রেরি, পাঠচক্র, বই পড়া সংগঠনের সাথে। জ্ঞান পিপাসা নিয়ে মানবিক উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণে এই সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম।
একজন স্বশিক্ষিত মানুষই পারে সুশিক্ষিত জাতি গঠন করতে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জীবন ও জীবিকা এক কঠিন সংগ্রামে নাম হয়ে গেছে ডিগ্রি অর্জনের পরেও মিলছে না কর্ম আর এর অন্যতম প্রধান কারণ স্বশিক্ষার অভাব। বিদ্যা প্রাথমিকভাবে একজন মানুষ অর্জন করে তার পরিবার ও পরে চারপাশের পরিবেশের কাছ থেকে।
একজন ব্যক্তির বাস্তবমুখী শিক্ষা অর্জনে মূখ্য ভূমিকা রাখে তার পরিবার। পরিবার থেকেই প্রথমে শিশুকে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে তারপর প্রয়োজন ভালো সঙ্গী যার সান্নিধ্যে সে ভালো পথ দেখবে। বই থেকে জ্ঞান অর্জনই বিনোদনের শ্রেষ্ঠ উপায়। বই মানুষকে হাসাতেও পারে আবার কাঁদাতেও পারে। পাঠ্য বইকে করতে হবে বাস্তবমুখী। পুঁথিগত বিদ্যায় থাকে দায়বদ্ধতার সম্পর্ক যা এড়িয়ে মানবিক উন্নয়ন করার উদ্দেশ্যে জ্ঞান অর্জন করাই হোক শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য।